সুদের কারবারি হীরা মোল্লা

সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে সুদের কারবারিদের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অসহায় সাধারণ মানুষ। সুদের টাকা দিতে ব্যর্থ হলে মারধরের শিকার হওয়ার পাশাপাশি ছাড়তে হচ্ছে বাড়ি। ফলে সুদের টাকা নিয়ে বিপাকে পড়েছে গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার। এমন ঘটনা ঘটছে উপজেলার রায়দৌলতপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার ধলেশ্বর গ্রামের মৃত নেজাবত আলী মোল্লার ছেলে হীরা মোল্লা ও তার তিন সহযোগী মিলে শুরু করেন সুদের ব্যবসা। তার অন্য সহযোগীরা হলেন, গোপালপুর গ্রামের মৃত সোহরাব আলীর ছেলে আমিরুল, বাড়াকান্দি গ্রামের ছাখাওয়াতের ছেলে মাসুদ ও ধলেশ্বরের আবু সাইদ। অভিযোগ রয়েছে, তাদের কাছে ১ লাখ টাকা ঋণ চাইলে তার বিপরীতে দেওয়া হয় ৭০ হাজার টাকা। এছাড়া সেই টাকার জন্য প্রতি সপ্তাহে ২ হাজার ৫০০ টাকা সুদ দিতে হয়। আবার কিস্তিতে নগদ টাকাসহ সুদ পরিশোধ করলেও নতুন করে টাকা দাবি করেন তারা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, সম্প্রতি টাকা পরিশোধ করার পরেও রানা মন্ডল নামের এক ভ্যানচালককে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে হীরা ও তার তিন সহযোগী। এসময় স্থানীয়রা সুদের ব্যবসায়ী হীরা, মাসুদ ও আমিরুলকে আটক করে। কিন্তু কৌশলে মাসুদ পালিয়ে যায়। এরপর স্থানীয়রা হীরা ও আমিরুলের বক্তব্য নিয়ে তাদের ছেড়ে দেন।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী রানা মন্ডল বলেন, ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। টাকা পরিশোধ করেছি। কিন্তু হঠাৎ করে কল দিয়ে তারা আমাকে বলছে টাকা দেওনা কেন? আমি বললাম টাকা তো আমিরুলের কাছে পরিশোধ করেছি। তখন আমাকে তারা গালাগালি করেন। এরপর কাজ থেকে ফেরার পথে আমাকে তুলে নিয়ে  যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন এলাকাবাসী সুদ কারবারি হীরা, আমিরুল ও মাসুদকে আটক করে।

সেলিম নামের এক ভ্যানচালক বলেন, একটি ভ্যান কেনার জন্য তাদের কাছে থেকে ৩০ হাজার টাকা চাই। কিন্তু ৩০ হাজার টাকার সুদ হিসেবে ৪ হাজার টাকা সঙ্গে সঙ্গে কেটে নিয়ে আমাকে ২৬ হাজার টাকা দেয়। কিছুদিন সুদ ও টাকা দেওয়ার পরে গাড়িটি হারিয়ে যাওয়ায় ঢাকা চলে যাই। ঢাকা থেকে আসার পরে আমাকে তারা বাঁশতলার একটি দোকানে আটকে রেখে মারধর করে। সুদসহ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা পরিশোধ করার পরেও তারা আমার কাছে নতুন করে টাকা দাবি করছে।

মশিউর রহমান নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, জামতৈল যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলে ধলেশ্বর তালতলা বাজারে পৌঁছালে তারা আমাকে থামিয়ে একটি কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে আটকে রেখে টাকা দাবি করে। আমি সুদসহ টাকা পরিশোধের বিষয়টি বললে আমাকে তারা মারধর করেন এবং জোড়পূর্বক একটি চেকে স্বাক্ষর নেন। স্বাক্ষর নিয়ে ১৮ লাখ টাকার মামলা দেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গোলাম মওলা বলেন, কৃষক, ভ্যানচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ প্রায় ৫০ জন সুদের কারবারিদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। বেশির ভাগ মানুষ সুদসহ তাদের টাকা ফেরত দিলেও তারা আবার টাকা দাবি করে। তাদের জন্য ভ্যানচালকেরা ঠিকমতো বের হয়ে কাজ করতে পারে না। যেখানে পায় সেখানেই চড় থাপ্পড় মারেন। তাদের অত্যাচারে ৫-৬টি পরিবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, আমি তাদের কাছ থেকে ৬৭ হাজার টাকা নিয়েছিলাম। এরপর দুই লাখের বেশি টাকা পরিশোধ করেছি। তারপরও তারা টাকা দাবি করছে। টাকা না দিতে চাইলে তারা আমাকে মারধর করে এবং জোড় করে চেকে স্বাক্ষর নিয়ে রাখে।

রায়দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের ১, ২ ও ৩নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য শিউলি বেগম বলেন, রসুলপুর এলাকার কৃষক, ভ্যানচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সহজ সরল। না বুঝে টাকা নিয়েছে। হীরা, মাসুদ,আমিরুল ও সাইদ মানুষকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে। তাদের অত্যাচারে এলাকার অনেক মানুষ পলাতক রয়েছে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের সময় আমি ১ লাখ টাকা ঋণ চেয়েছিলাম। ১ লাখ টাকার পরিবর্তে তারা আমাকে ৭০ হাজার টাকা দিয়েছিল। পরে সুদসহ ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছি।

রায়দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ আকন্দ বলেন, সুদ যারা নেয় এবং যারা দেয় তারা দুজনেই সমান অপরাধী। রসুলপুর গ্রামের মানুষ যে হীরাদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছে এটা আমি জানি না। আমাকে কেউ জানায়নি। তবে উভয় পক্ষ এলে বিষয়টি নিয়ে কম বেশি করে দেওয়া যাবে।

এদিকে, সুদ কারবারি হীরার মুঠোফোনে কল দিলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তিনি পরে কথা বলবেন বলে ফোন কেটে দেন। এরপর একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

হীরার আরেক সহযোগী আমিরুল বলেন, আমি এসবের সঙ্গে জড়িত নই। আমি অসুস্থ মানুষ। হীরা আমার স্কুল জীবনের বন্ধু, এজন্য রসুলপুর গিয়েছিলাম। আমি বিদেশে ছিলাম, আবার বিদেশ যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছি।

এদিকে, হীরা ও তার তিন সহযোগীর অত্যাচারের বিষয়ে সম্প্রতি জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগও করেছেন গ্রামবাসী। লিখিত অভিযোগের অনুলিপি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কামারখন্দ থানায়ও দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে কামারখন্দ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুর নবী প্রধান বলেন, অনুলিপির কপিটি অফিসিয়ালি এখনো হাতে পাইনি। হাতে পাওয়ার পর বিষয়টি জানানো যাবে৷

কামারখন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেরিনা সুলতানা বলেন, ডিসি স্যারের কাছে আবেদন দিলে ওইটা আমার কাছে তদন্তের জন্য আসার কথা। এলে তখন তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শুভ কুমার ঘোষ/এবিএস