বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার, গ্রন্থাগার, নামাজঘর, শহীদ মিনার, উপকরণ কর্নার, মিনা রাজু পার্ক, পতাকা মঞ্চ, ভূগোলক, রিডিং কর্নার, হাসান আলী স্কয়ার, আমাদের ভুবন, পশুপাখির ম্যুরালসহ নানা স্থাপনা স্থানীয়ভাবে স্থাপন করেছেন। মনোমুগ্ধকর ও দৃষ্টিনন্দন এসব স্থাপনা শিশু শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আসতে ও লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে অনেক সহায়ক।

আর অভাবনীয় এসব কাজ যিনি সম্পাদন করেছেন, তিনি হলেন বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম। কোমলমতি শিশুদের কাছে তিনি যেমন প্রিয়, তেমনি তিনি সারা দেশে আলোচিত অন্য কারণে। কারণ, শহিদুল ইসলাম হলেন দেশসেরা প্রধান শিক্ষক।

বিক্রেতা ছাড়া বিদ্যালয়ে ‘সততা স্টোর’ চালু করে আলোচনায় আসা শহিদুল ইসলামকে ‘জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ ২০১৯’ উপলক্ষে ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর দেশসেরা প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২ নভেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (বিদ্যালয়-২) শামীম আরা নাজনীন স্বাক্ষরিত পত্রে বিষয়টি তখন নিশ্চিত করা হয়।

উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, মো. শহিদুল ইসলাম ২০১৪ সাল থেকে সাত বছর ধরে কোনো নৈমিত্তিক ছুটি ভোগ করেননি। বিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজের জন্য স্থানীয় ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি তিনি প্রায় পাঁচ লাখ টাকা বিদ্যালয়ের তহবিলে অনুদান দিয়েছেন। শহিদুল ইসলাম বিদ্যালয়ে যোগদানের পর বিদ্যালয়টি ব্যাপক সাফল্য পায়। সমাপনী পরীক্ষায় ভালো ফলের জন্য তিনি বিদ্যালয়ের সময়সূচির বাইরে বৈকালিক ও নৈশকালীন বিদ্যালয়ও চালু করেছেন।

সরেজমিনে গতকাল শনিবার (২০ মার্চ) বালিয়াকান্দি উপজেলার জেলার মধ্যে সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলে দেখা মেলে তার। এই প্রতিবেদক গিয়ে দেখেন, করোনাকালে বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও তিনি বিদ্যালয়ের আঙিনায় সূর্যমুখীগাছের পরিচর্যা করছেন।

সেরা শিক্ষক নির্বাচিত হওয়া প্রসঙ্গ নিয়ে ঢাকা পোস্ট মো. শহিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে। তিনি বলেন, আমি দেশসেরা প্রধান শিক্ষক হব, সেটা কোনো দিন কল্পনা করিনি। এই সাফল্যের পেছনে সৃষ্টিকর্তার অবদান রয়েছে। তবে শিক্ষক হিসেবে যেটি সব সময় মনে করেছি, সেটি হলো, আমরা মানুষ গড়ার কারিগর। প্রাথমিক স্তরে সাধারণত কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। তাদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখাটাই বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। এই প্রতিযোগিতার মধ্যে তাকে পড়ালেখা করে ভালো ফলাফল নিশ্চিত করাটা একটি কঠিন কাজ। সেই কাজ করতে হলে বিদ্যালয়ে যেন শিক্ষার্থীরা মনোনিবেশ করতে পারে, সেটা গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যালয়ে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছি। শিক্ষার্থীরা যেন এসব স্থাপনার কারণে ভালো মনে পড়ালেখা করতে পারে।

তবে প্রথম দিকে সততা স্টোর করে আমি গণমাধ্যমের কারণে ব্যাপক আলোচনায় আসি। বিক্রেতা ছাড়া এই স্টোরটি শত শত শিক্ষার্থীকে নৈতিক শিক্ষা দিয়েছে। করোনাকালে শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়, সেই চিন্তা তার মাথায় রয়েছে বলে জানান শহিদুল।

করোনাকালে বিদ্যালয়-সংলগ্ন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। তারা বলে, শহিদুল স্যার একজন মাটির মানুষ। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তিনি নিজের সন্তান মনে করেন। স্যার আমাদের অনেক আদর করেন। বিশেষ করে বিদ্যালয়ে তিনি কোনো দিন আমাদের পড়ালেখার ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করেননি।

বালিয়াকান্দি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মো. শহিদুল ইসলাম তার নিজ গুণে দেশসেরা প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি সত্যিকার অর্থেই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। আমরা তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, বিদ্যালয় ছাড়া তার চিন্তায় অন্য কিছু নেই। বালিয়াকান্দির মানুষ হিসেবে তার এই কর্মযোগ্য আমাদের গর্বিত করে।

বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আম্বিয়া সুলতানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মো. শহিদুল ইসলাম দেশসেরা প্রধান শিক্ষক হয়েছেন, এটা স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য গর্বের বিষয়, বালিয়াকান্দিবাসীর জন্য গর্বের বিষয়। শহিদুল ইসলাম সারা দেশের শিক্ষকদের মধ্যে একজন মডেল। মো. শহীদুল ইসলাম জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হওয়ায় আমি দারুণভাবে খুশি। আমার এই ছোট্ট উপজেলার মধ্যে থেকে যে তিনি এই গৌরব অর্জন করেছেন, সেটা শুধু তার একার নয়, আমাদের উপজেলার সবার গৌরব।

শহিদুল ইসলাম ১৯৭১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। তিনি ১৯৯৮ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৮ সালে স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি জেলার সেরা প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে নির্বাচিত হয়। ২০১৬ সালে তিনি বালিয়াকান্দি উপজেলার প্রথম শিক্ষক হিসেবে সরকারি ডিওতে ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণ করেন।

এনএ