দারিদ্র্য, অসচেতনতা, যৌতুকপ্রথা ও বাল্যবিবাহসহ নানা কারণে দিন দিন বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পারিবারিক সহিংসতা, স্বামীর বেকারত্ব ও নারীর কর্মসংস্থানের অভাব-অনিরাপত্তাকেও অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।

তিস্তা, ধরলা ও সানিয়াজান নদীবেষ্টিত লালমনিরহাট জেলার পাঁচটি উপজেলায় প্রায় অর্ধশত চরাঞ্চল রয়েছে। যার অধিকাংশ মানুষই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। আর এসব কারণে এ জনপদে যৌতুকহীন বিয়ে কল্পনাও করা যায় না। এ জেলায় গত এক বছরে দেড় হাজারের ওপর বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে এ জেলায়। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সদর উপজেলার দুটি ইউনিয়নে ২৭টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে।

শিক্ষার দিক থেকেও অনগ্রসর এসব চরাঞ্চলের মানুষ। অজ্ঞতা ও কুসংস্কার থেকে স্বাধীনতার অর্ধশত বছরেও উত্তরণ ঘটেনি এ জনপদের। এসব চরাঞ্চলে আর্থিক অসংগতি ও অসচেতনতার কারণে দিন দিন বাড়ছে বাল্যবিবাহসহ নানা ধরনের সামাজিক অপরাধ। ভয়াবহ বাল্যবিবাহ ও যৌতুকপ্রথার কারণে এ জনপদে পারিবারিক সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলছে। ফলে বেড়েছে বিবাহবিচ্ছেদও।

অন্যদিকে দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই পরিবার-পরিজন রেখে দীর্ঘদিন এলাকার বাইরে কর্ম এলাকায় অবস্থান করেন। কেউ থাকেন প্রবাসে। এসব কারণে পরকীয়া সম্পর্কের প্রবণতাও বেড়েছে। একসময় পরকীয়া সম্পর্কের কারণে দীর্ঘদিনের বৈবাহিক সম্পর্ক গড়াচ্ছে বিচ্ছেদে।

ইদানীং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবাদ  যোগাযোগের সহজলভ্যতাও পরকীয়ায় জড়ানোর একমাত্র হাতিয়ার। এসব কারণে বিবাহবহির্ভূত দৈহিক সম্পর্ক যেমন বাড়ছে, অনুরূপভাবে তা একপর্যায়ে গিয়ে জোরপূর্বক বিয়ে থেকে বিবাহবিচ্ছেদেও রূপ নিচ্ছে।

অন্যদিকে নারীদের নিরাপদ কর্মসংস্থান না থাকায় অনেকেই বেকারত্বে পড়ে পুরুষের আয়ের ওপর নির্ভরশীল থাকেন। আবার স্বামীর বেকারত্ব নানা অশান্তি বয়ে আনে। ফলে পারিবারিক সহিংসতাও লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বিবাহবিচ্ছেদ সবচেয়ে উদ্বেগজনক চিত্র হচ্ছে পারিবারিক এসব কলহ।

জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলা ও দুটি পৌরসভায় ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে ৫ হাজার ৭৬১টি বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। একই বছর বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে ১ হাজার ৬৫৭টি। যার মধ্যে পুরুষের পক্ষ থেকে বিচ্ছেদ হয়েছে ১৮০টি ও নারীর পক্ষ  থেকে হয়েছে ৫৫৮টি। আর স্বামী-স্ত্রী যৌথভাবে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে ৯১৯টি।

সদ্য বিবাহবিচ্ছেদের শিকার হাতীবান্ধার সিংগিমারী এলাকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ঢাকা পোস্টকে জানান, বন্ধুত্ব থেকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাদের দুজনের মধ্যে। পারিবারিকভাবে আলোচনা করে প্রেমিকাকে বিয়ে করেন তিনি। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই তার শাশুড়ির চাপে  তার স্ত্রী সম্পর্কের ইতি টানেন। তবে বিচ্ছেদ না করে দীর্ঘ পাঁচ বছর টালবাহনা করতে থাকেন। গ্রাম্য সালিসে দেনমোহরসহ মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয় তার কাছে। বাধ্য হয়ে নিজ থেকে বিচ্ছেদ করেন তিনি।

তবে তার সদ্য বিচ্ছেদ করা স্ত্রী উল্টো অভিযোগ করে বলেন, আমাদের প্রেমের বিয়ে এবং আমার স্বামীর আচরণ ভালো নয়। তাই পরিবারের সিদ্ধান্তে স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছিলাম। বৈঠক বসলেও দেনমোহর দিতে অস্বীকার করে সে। হঠাৎ দেখি বিবাহবিচ্ছেদের কাগজ এসেছে আমার কাছে। এ নিয়ে আমি আতালতে মামলা করেছি।

কথা হয় শাহজাহান মিয়া-রেজিনা বেগম দম্পত্তির সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে জানান, পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুশাসন না থাকায় পরিবারে বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে। পারিবারিক বন্ধন আরও সুদৃঢ় করতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মাঝে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা আবশ্যক। প্রত্যেক মানুষ জীবনের প্রথম শিক্ষা পরিবার থেকেই পেয়ে থাকে। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। সবার খোঁজখবর রাখতে হবে। তবেই পারিবারিক সম্পর্ক মধুর হয়ে ওঠে।

শিক্ষক দম্পতি মিজানুর রহমান মিজান ও আরিফা রহমানের সঙ্গে বর্তমান পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানতগ নানা দিক নিয়ে কথা হয়। বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে এবং এসব থেকে উত্তরণে কোন ধরনের সম্পর্ক জরুরি, এমন প্রশ্নে তারা বলেন, বিশেষ করে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে তরুণ-তরুণীদের মাঝে বেশি। আর উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণির পরিবারের মাঝে সহিংসতার কারণে। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ছেলেমেয়েদের মধ্যে জানাশোনা থাকলে বিবাহবিচ্ছেদ কম হয়। 

করোনাকালীন বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে তারা বলেন, গত বছরে করোনা সংক্রমণের কারণে অনেকেই ঘরের ভেতরে থেকেছে। যে কারণে ছোটখাটো ঘটনা নিয়েই রাগ অভিমান থেকেই বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। তা ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়েও সন্দেহজনিত কারণে বিবাহবিচ্ছেদের হারও বেড়েছিল।

সোশ্যাল মিডিয়ায় অনৈতিক সম্পর্কের মাত্রা বাড়ছে, ফলে এসব কারণেও বিবাহবিচ্ছেদও বাড়ছে। এসব কমাতে গেলে প্রথমত দুজনের মধ্যে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। না হলে বিবাহবিচ্ছেদ কখোনই কমে যাবে না। একে অপরের দোষগুলো আমরা যদি অতটা গুরুত্ব দিয়ে না দেখি, তাহলে পরিবারের মাঝে দ্বন্দ্ব লাগবে না। সুন্দর একটি পরিবার গড়ে উঠবে।

টিভি সিরিয়ালের বিষয়ে দম্পতিরা বলেন, ভারতীয় সিরিয়ালের প্রভাব আমাদের দেশের পরিবারে পড়ছে। এসবে অভ্যস্ত হয়ে অনেক বিবাহবিচ্ছেদ করে ফেলে। অনেক সময় দেখা যায় ঝকঝকে-চকচকে কাপড়চোপড় পরছে ভারতীয় সিরিয়ালে। গ্রামীণ ও শহুরে জীবনে এসব দেখেই স্ত্রী স্বামীর কাছে বায়না ধরে কিনে দিতে। অনেক সময় তা না এনে দিলে পরিবারের মাঝে লেগে যায় ঝগড়াঝাঁটি। এ থেকেই সম্পর্ক গড়ায় দ্বন্দ্বে, তারপর বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে দুটি পরিবার আলাদা হচ্ছে। এসব থেকেই সতর্ক থাকতে হবে।

বাল্যবিবাহ নিয়ে তারা বলেন, তিস্তা চরাঞ্চলে কোমলমতি শিশুদের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয় দিচ্ছেন বাল্যবিবাহ। দীর্ঘতম চরাঞ্চলে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে যেতে পারেনন না। এই সুযোগেই পরিবারের লোকজন দিয়ে দিচ্ছেন বাল্যবিবাহ। ওই বয়সেই তারা বুঝতে পারছেন না বিবাহবিচ্ছেদ কী। রাগ-অভিমান করে তারা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে এসব পরিবারও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এসব পরিবারকে সচেতনামূলক কার্যক্রম করলে অনেকটা রেহাই পাবে।

স্থানীয় এনজিও আরডিআরএস বাংলাদেশ লালমনিরহাটের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর রাশেদুল আরেফিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পারিবারিক সহিংসতা থেকে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে থাকে। দাতা সংস্থার সহায়তায় আমরা পারিবারিক সহিংসতা রোধে ও নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়িয়ে আইনি সেবা পৌঁছানোর কাজ করেছি। বর্তমানে দাতা সংস্থা না থাকায় এসব বিষয় নিয়ে কেউ কাজ করছে না। তবে নারীদের আইনি সহায়তা দিয়ে অনেক বিবাহবিচ্ছেদও রোধ করেছি। তারা আজও সুখের সংসার করছেন।

দুর্গাপুর ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার কাজী মাহমুদুল হাসান জুয়েল বলেন, ইদানীং বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে। তবে পরকীয়ার কারণে নারী পক্ষে একক বিচ্ছেদটা বেশি ঘটছে। বিচ্ছেদের নোটিশ করা হলে সামান্য কিছু ঘটনা ইউনিয়ন পরিষদে মিটে গেলেও অধিকাংশ সম্পর্ক চূড়ান্ত বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়াচ্ছে। তিনি আরও জানান, গত তিন মাসে এই ইউনিয়নে ১০টি বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। বেশির ভাগই ঘটেছে দরিদ্র শ্রেণির পরিবারে।

অন্যদিকে পালাশী ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার কাজী এন কে এম লিটন মোল্লা বলেন, এই ইউনিয়নে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত ১৭ জনের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। তারা সবাই তরুণ-তরুণী।

লালমনিরহাট পৌরসভার নিকাহ রেজিস্ট্রার কাজী আমজাদ হোসেন বলেন, গ্রামের মতোই শহরেও বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে। পারিবারিক, সামাজিক ও নানা অবক্ষয়ের কারণ ও সহিংসা থেকেই বিচ্ছেদের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে ঘটছে। চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত ১৭ জনের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। তারা সবাই তরুণ-তরুণী।

মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিবাহবিচ্ছেদ বা তা রোধ করার পরিসংখ্যান বলা কষ্টকর। নিকাহ রেজিস্ট্রার অফিস থেকে তালাকের কাগজ এলে স্বামী-স্ত্রী দুই পক্ষকেই ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নোটিশ করে বৈঠকের আহ্বান করা হয়। সেখানে আলোচনা করে বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। অনেক সময় পরকীয়ার কারণে যেসব বিচ্ছেদের নোটিশ আসে, তা ফেরানো সম্ভব হয় না। তবে কিছু মামলায় দুপক্ষকে বুঝিয়ে সমাধান করা হলে তারা আবার বৈবাহিক জীবনে ফিরে যায়।

বর্তমানে নীতিনৈতিকতার অভাব হয়ে গেছে সমাজ ও পারিবারিক জীবনে। ফলে অনেক সুখের পরিবার লন্ডভন্ড করে দিয়ে বিবাহবিচ্ছেদে শামিল হয়েছে জানিয়ে কালীগঞ্জ করিম উদ্দিন পাবলিক পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খুরশীদুজ্জামান আহমেদ বলেন, আমরা খেয়াল করছি যে মেয়েরা অনায়াসে ছেলেদের তালাক দিচ্ছে। আবার ছেলেরা মেয়েদের তালাক দিচ্ছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও কষ্টকর। দ্রুত এসব সমাধানে সবেইকে এগিয়ে আসতে হবে।

লালমনিরহাট জেলা জজ আদালতের অ্যাডভোকেট আবু আহাদ খন্দকার লেলিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মূলত বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা সব পরিবারেই আছে। তবে বেশির ভাগ সময় দেখা যায় প্রান্তিক ও উচ্চবিত্ত পরিবারে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যা একেবারে কম। কারণ, তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হলেও তারা আদালত পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রান্তিক ও উচ্চবিত্ত পরিবারে মধ্যে এ বিষয়গুলো দেখা যায় না।

লালমনিরহাট জেলা রেজিস্ট্রার খালিদ মোহাম্মদ বিন আসাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনটি পদ্ধতিতে একটি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটতে পারে। স্ত্রী একক, স্বামী একক ও উভয়ে সমঝোতার ভিত্তিতেও বিবাহবিচ্ছেত করতে পারেন। এ জেলায় এক বছরে ১ হাজার ৬৫৭টি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় লালমনিরহাট জেলার পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানার সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনে যেসব মামলা আমরা পেয়ে থাকি, সেগুলো বিবেচনা করে যেটা মনে হয় যে ‘পারিবারিক সহিংসতা, নারী নির্যাতন ও যৌতুকের জন্য মারপিটের কারণে বেশির ভাগ বিবাহবিচ্ছেদ হয় এ জেলায়। এসব কমাতে পুরুষতান্ত্রিক নারীদের প্রতি যে একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, সেটা উভয় পক্ষকে বদলাতে হবে। তা ছাড়া আমাদের ব্যাপকভাবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেওয়া উচিত। এমন কার্যক্রম হাতে নিলে সন্তানরা ধর্মীয়, সামাজিক ও ন্যায়নীতির শিক্ষাগুলো পাবে। তাহলে অনেক অপরাধ থেকে আমরা সমাজকে মুক্ত করতে পারব। তবেই সব ধরনের অপরাধ কমে যাবে বলে তিনি জানান।

এনএ