দুই বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেন, এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নেওয়া। সেই টাকা দিয়ে ধান আবাদ করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিলেন বাগেরহাট সদর উপজেলার দক্ষিণ খানপুর এলাকার স্নিগ্ধা ফাতেমা। বছর খানেক আগে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ৪ সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব এসে পড়ে ২১ বছর বয়সী কলেজছাত্রী ফাতেমার কাঁধে। তবে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ক্রমাগত চাপে তার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে। লোনাপানিতে নষ্ট হয়ে গেছে জমির সব ধান।

স্বিগ্ধা ফাতেমার মা স্বপ্না বেগম বলেন, `এই জমিতে ধান চাষ করতে রাত দিন খেয়ে না খেয়ে পরিশ্রম করেছে আমার মেয়ে। আমিও সংসারের কাজ ফেলে মেয়েরে সহযোগিতা করেছি। যে ধান হয়েছিল তা দেহে (দেখে) পরানডা (প্রাণ) জুড়ে গেছিল, ভাবিলাম আল্লাহ আমাগো দিকে মুখ তুলে চাইছে। কিন্তু জমিতে লোনাপানি ডুইকে (প্রবেশ করে) সব শেষ আমার, এইবার আমরা কিস্তির টাকা দিব কি করে। এভাবেই নিজের কষ্ট আর হতাশার কথা জানাচ্ছিলেন ফাতেমার মা স্বপ্না বেগম।'

এমন চিত্র বাগেরহাটের অন্তত তিনটি উপজেলার ৪০ থেকে ৪৫টি এলাকার। একদিকে চাষাবাদের জন্য মিষ্টি পানির অভাব, অপরদিকে স্থানীয় প্রভাবশালীরা খালে লোনাপানি প্রবেশ করিয়ে মাছ চাষ করছেন। এসব কারণে গত এক মাসে তিনটি উপজেলায় অন্তত ১ হাজার ২০০ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে, ক্ষতি হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এর মধ্যে রামপাল উপজেলায় ধান কাটার মাত্র ১৫ দিন আগে খালে লোনাপানি প্রবেশ করানোয় নষ্ট হয়ে গেছে প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ইরি ধান। চিংড়ির পোনা ছাড়ার সময় হওয়ায় প্রভাবশালী ঘের মালিকরা খাল কেটে ধানের জমিতে লোনাপানি প্রবেশ করানোয় দুই শতাধিক কৃষকের প্রায় কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে এই লোনাপানি ধানের জমিতে ১৫ থেকে ২০ দিন পরে প্রবেশ করালে কোনো ক্ষতি হতো না বলে দাবি কৃষকদের।

জানা যায়, বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার পেড়িখালী ইউনিয়নের সিঙ্গড়বুনিয়া এলাকার মান্নান শেখ ধান ঘরে তুলতে মাত্র ২০ দিন সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীরা চিংড়ি চাষের জন্য খালের বাঁধ কেটে লোনাপানি প্রবেশ করানোয় নষ্ট হয়ে গেছে তার সব ধান।

শুধু পেড়িখালী নয়, উপজেলার রাজনগর ইউনিয়নের কালেখারবেড়, রনজয়পুর ও আড়ুয়াডঙ্গা এলাকায়ও ঘের ব্যবসায়ীরা খাল কেটে লোনাপানি প্রবেশ করানোয় মরতে শুরু করেছে জমির ধান।

রামপালের কৃষক হুমায়ুন কবির ঢাকা পোস্টকে জানান, হঠাৎ ঘেরে লবণ পানি ঢোকাতে খালের বাঁধ কেটে দেন ঘের মালিকরা। বাঁধটি কাটার আগে চেয়ারম্যান, কৃষি কর্মকর্তা ও ইউএনওকে বিষয়টি জানানো হয়। ধান কেটে ঘরে তোলার জন্য মাত্র ২০ দিন সময়ও চেয়েছিলেন। কিন্তু কেউ তাদের কথা শোনেননি।

রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজিবুল আলম বলেন, কাউকে সরকারি খাল আটকে রাখার অনুমতি দিতে পারি না। তবে ঘের ব্যবসায়ী ও কৃষকদের মাঝে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল সেটা সমাধানের জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা সমাধান করবেন।

মোরেলগঞ্জে কৃষকরা ধান কাটার ১৫ দিন আগে একই কায়দায় মাছের ঘেরে লোনাপানি তোলার কারণে ৩০০ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। ঘটনার বিচার চেয়ে কয়েকদিন আগে ধানক্ষেতের পাশে মানববন্ধনও করেন ভুক্তভোগীরা।

মোরেলগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (ইউএনও) আকাশ বৈরাগী বলেন, প্রভাবশালীরা ঘেরে লোনাপানি তুলে হতদরিদ্র কৃষকদের অপূরণীয় ক্ষতি করে দিয়েছে। তারা দেনা হয়ে গেছেন। লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সদর উপজেলার বড় বাঁশবাড়ীয়া এলাকার হাওলাদার মামুন পাচ বিঘা জমিতে ধান রোপণ করেছিলেন। তার জমি কৃষি বিভাগের সহায়তা পাওয়া ব্লকের মধ্যেও ছিল। প্রায় ৮০ হাজার টাকা ব্যয়ও করেছেন। কৃষি বিভাগের করা সেচ লাইন দিয়ে পানি দিয়েছেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে তার জমির ধানও মরে গেছে। নদীতে লোনাপানি প্রবেশ করানোয় তা সেচ লাইনেও চলে আসে। এতেই ক্ষতির মুখে পড়েছেন তিনি।

একই চিত্র সদর উপজেলার ডেমা, খানপুর ও যাত্রাপুর ইউনিয়নে। সেখানেই অন্তত ৪০০ বিঘা জমির ধান পচে গেছে। ডেমা ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া ও ছবাকি স্লুইস গেট দিয়ে ছবাকি নদীতে লোনাপানি ঢোকানোর কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে হাড়িখালীসহ পাশাপাশি তিনটি স্লুইসগেট থেকে পুটিমারী বিলে লোনাপানি ঢোকায় স্থানীয় হাড়িখালী ক্ষুদ্র পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি। এতে পুটিমারী বিলের অন্তত ২০০ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে যায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেমা ইউনিয়নের কয়েকজন কৃষক জানান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেনসহ স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছবাকি ও বাঁশবাড়িয়া স্লুইসগেট দিয়ে লোনাপানি ঢোকান।

তবে বিষয়টি অস্বীকার করে ডেমা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন দাবি করেন, কৃষকদের সম্মতিতে মাঘী পূর্ণিমার সময় গেট দিয়ে পানি ঢোকানো হয়েছে। কারণ তখন পানি মিষ্টি ছিল। পরে আর পানি প্রবেশ করানো হয়নি।

এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবাইয়া তাসনিম বলেন, ইতোমধ্যে উপজেলা কৃষি বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছি, তারা পুরো এলাকা সরেজমিনে দেখবেন এবং ক্ষতির পরিমাণ জানাবে। এসব গেট থেকে যাতে লোনাপানি প্রবেশ করাতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন তিনি।

এ ব্যাপারে বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, লোনাপানি যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য আমরা গেট বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু রাতের আধারে কে বা কারা গেট খুলে লোনাপানি প্রবেশ করায় তা আমরা জানি না। শুনেছি নকল চাবি বানিয়েছে। আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি।

এবিএস