‘নাম তার ছিল জন হেনরি, ছিল যেন জীবন্ত ইঞ্জিন, হাতুড়ির তালে তালে গান গেয়ে শিল্পী, খুশিমনে কাজ করে রাত-দিন।’ গণশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বাংলা ভাষায় অনুদিত এই গানটি কখনো শুনেননি হাতুড়ি দিয়ে ৩০ বছর ধরে কাজ করা শ্রমিক রিজিয়া বেগম। কিন্তু রিজিয়া জন হেনরির মতো স্টিম-ড্রিল মেশিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে চালান হাতুড়ি। আধুনিক যন্ত্রপাতির যুগে এসব শ্রমিকদের সংখ্যাও দেশে কম নয়। হাতুড়ি দিয়ে ইট ভাঙা শ্রমিকরা ১০০ ইট ভাঙলে পান ২২৫ টাকা। কিন্তু প্রতিদিন ১০০ ইট ভাঙা যায় না। জীবনভর মালিকপক্ষের অট্টালিকা তৈরির ইট ভাঙলেও শ্রমিক রিজিয়ার পায়ের নিচে মাটি কিংবা থাকার মতো কোনো ঘরবাড়ি নেই।

আজ পহেলা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। দিবসটি এলেই সকলের মনে পড়ে শিকাগোর শ্রমিক আন্দোলনের কথা। মালিকের আগ্রাসনে শিকাগোর শ্রমিক আন্দোলনের আগুন নিভু নিভু জ্বলছে সারা বিশ্বে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। শরীয়তপুরে শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন থাকলেও দৃশ্যমান দাবি-দাওয়া নিয়ে নেই কোনো লড়াই-সংগ্রাম। রিজিয়ার মতো হাজারো শ্রমিকরা হাজার বছর ধরে না খেয়ে, না পড়ে জীবন পার করছেন।

শরীয়তপুরের ভোজেশ্বর এলাকার ভাড়াটিয়া আলী আহমেদ খানের স্ত্রী ভূমিহীন রিজিয়া আরও বলেন, ইট ভাঙার কাজ অনেক পরিশ্রমের। কিন্তু আয় খুবই অল্প। বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম, চাল কিনতেই টাকা শেষ। বছরে একদিনও ভালো-মন্দ চোখে দেখি না। শ্রমিক দিবস কী জানি না আমি।

ধানুকা এলাকার মৃত আজহার মোল্লার স্ত্রী জবেদাও রিজিয়ার সঙ্গে ইট ভাঙার কাজ করেন। জবেদার এক ছেলে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে চিকিৎসার অভাবে ঘরে পড়ে আছেন। সে জন হেনরির কচি ফুল মেয়েটির মতো চেয়ে থাকলেও মা জবেদা ছেলের চিকিৎসার টাকা নিয়ে ঘরে ফিরতে পারেন না। ঢাকা পোস্টকে জবেদা বলেন, ‘প্রেমের গান শুনেছি, শ্রমিকের গান আছে কি না জানি না। ইট ভেঙে ভাত জোগাড় করি। ভাঙা ঘরে থাকি, ছেলের চিকিৎসার টাকা পাব কই?’

মো. রাব্বি

শরীয়তপুরে কয়লা টানার কাজ করেন শ্রমিক মো. রাব্বি। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের বেতন ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। কয়লার কাজ করলে শরীরের ক্ষতি হয়। কিন্তু এসব দেখলে তো চলবে না। আমরা গরিব মানুষ, কাজ করে খেতে হবে।

গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রান্নার শ্রমিকের কাজ করেন আব্দুস সালাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনুষ্ঠানে নিজে খেতে পারলেও টাকার অভাবে স্ত্রী-সন্তানের জন্য ভালো খাবার কিনতে পারি না। পোলাও, কোরমা, রোস্টসহ সকল পদের রান্না রেঁধে একদিন স্ত্রী-পরিজন নিয়ে খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু রান্না শ্রমিকের কাজ কমে গেছে এখন। পথে প্রান্তরে নামিদামি রেস্টুরেন্ট ও পার্টি সেন্টার হওয়ার কারণে প্রত্যন্ত গ্রাম ছাড়া উপজেলা শহরেও এখন রান্নার কাজ পাওয়া যায় না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভালো খাবারের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে হয়ত।

বাঁশ দিয়ে ঘরের শোভাবর্ধনকারী বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি করেন শ্রমিক মো. খলিল। এছাড়া জেলেদের জন্য মাছ ধরার ফাঁদ, কৃষকদের মাথার মাথাল, গৃহিণীর চালুনসহ বিভিন্ন উপকরণ আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই মাত্র একটি দা দিয়ে তৈরি করেন মো. খলিল। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কেউ আমাদেরকে নিয়ে ভাবে না। শ্রমিক নেতা থেকে সরকার, কারও চিন্তাতেই নেই আমরা।

এছাড়া জেলার ফসলি জমির খেতমজুর, বাস, সিএনজি, অটোরিকশা, ভ্যান শ্রমিক, ইটভাটা শ্রমিক, ইমারত নির্মাকারী শ্রমিক, হোটেল শ্রমিকসহ সকল পর্যায়ের শ্রমিকদের সর্বহারা কাব্যের কুলি মজুর কবিতার মতো বাবু সা’ব নিচে ফেলে দিচ্ছে প্রতিদিন।

ধানুকা এলাকায় ইট ভাঙার কাজ করেন জবেদা খাতুন। ছবি- ঢাকা পোস্ট

এক টাকায় ১৬ আনা, এক আনাকে ১২ ভাগ করলে হয় ‘এক পাই’। রিজিয়া, সালাম ও খলিলদের ‘পাই’  দিয়ে ‘ক্রোর’ (কোটি) পাওয়া মালিকদের বিষয়ে অটোরিকশা-সিএনজি শ্রমিক ইউনিয়নের শরীয়তপুর জেলার সভাপতি আজিজুর রহমান রোকন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শ্রমিকদের এক পাই দিয়ে মালিকরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। নানান পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকরা সমাজ বিনির্মাণে, পৃথিবী গড়তে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। অথচ এই শ্রমিকদের অবহেলা করা হচ্ছে। আমরা শ্রমিকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সত্যিকারের শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই।

এমজেইউ