দারিদ্রের নির্মম কষাঘাত সইতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। হারিয়েছেন কৃষক বাবাকেও। তবুও মনে ছিল বড় হওয়ার অদম্য ইচ্ছা। সেই ইচ্ছে পুষে রেখে দারিদ্র্যের নির্মম বাস্তবতার মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন শামীম মিয়া। চলতি মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু ফরম পূরণের জন্য অতিরিক্ত এক হাজার টাকা প্রধান শিক্ষককে না দেওয়ায় মেলেনি প্রবেশপত্র। এতে আর পরীক্ষার কেন্দ্রে বসা হয়নি শামীমের। 

এমন ঘটনা ঘটেছে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলায়। ভুক্তভোগী শামীম উপজেলার জুলগাঁও গ্রামের মৃত আব্বার আলীর ছেলে। সে উপজেলার ঘাগড়া দক্ষিণপাড়া ফজলুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের চলতি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল।

ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল হকের এমন কাণ্ড জানাজানি হওয়ার পর রীতিমতো ফুঁসে উঠেছে এলাকাবাসী। বুধবার (৩ মে) দুপুরে এ ঘটনার প্রতিবাদে ও শিক্ষকের বিচার দাবিতে উপজেলার কয়রোড চৌরাস্তা মোড়ে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করেছে স্থানীয় সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

ভুক্তভোগী শামীম মিয়া বলেছে, আমার বাবা নেই। খুব কষ্ট করে টাকা-পয়সা জোগাড় করে পড়ালেখা চালিয়ে আসছি। অভাবের কারণে এক হাজার টাকা ফরম ফিলাপের সময় কম দিছিলাম। কিন্তু স্যার কম নিতে রাজি হয়নি। স্যারকে বারবার অনুরোধ করেছি, বাকি টাকাটা পরে দিয়ে দেব।

এরপর সময়মতো প্রবেশ পত্র নিতে গেছি। স্যার ওই দিন বলছে, টাকা আনসস? আমি স্যারকে বলেছি, স্যার টাকাটা জোগাড় করতে পারিনি। তবে, আমি স্যার টাকাটা পরে দিয়ে দেব। তখন স্যার বলল, তুই পরীক্ষা দিবার যাইস তখন প্রবেশ পত্র দিমুনি। কিন্তু পরীক্ষা দিতে যাইয়া দেখি স্যার আসে নাই। এমনকি আমাদের স্কুলের কোনো স্যারকেই খুঁজে পাইনি। পরীক্ষা দিতে না পেরে আক্ষেপের সুরে শামীমের ভাষ্য, হেড স্যার আমার জীবনডা শেষ কইরা দিলো।

বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে গা-ঢাকা দিয়েছেন ঘাগড়া দক্ষিণপাড়া ফজলুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল হক। দুপুরে বিদ্যালয়ের গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি, তার চেয়ার ছিল ফাঁকা। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে। 

বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, শুনেছি প্রধান শিক্ষক অসুস্থ তাই স্কুলে আসেনি। আমি নিজেও বারবার ফোন দিয়েছি, কিন্তু ফোনে পাইনি।

শামীমের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, শামীম ফরম পূরণের সময় প্রধান শিক্ষককে দুই হাজার টাকা দিয়েছিল। দুই হাজার ছাড়াও অতিরিক্ত কিছু টাকা চাইলে শামীম দিতে পারেনি। পরে শুনলাম প্রবেশ পত্রের জন্য ছেলেটা পরীক্ষা দিতে পারেনি। এটা খুবই দুঃখজনক।

জানতে চাইলে এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রেজুয়ান আহম্মেদ বলেন, বিষয়টি জেনে আমি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে খোঁজ নিতে বলেছি।

এ বিষয়ে শেরপুর -৩ আসনের সাংসদ ইঞ্জিনিয়ার একেএম ফজলুল হক চাঁন বলেন, শামীমের বিষয়টি আমি অবগত হলাম। ব্যাপারটি আমি দেখবো।

ক্ষোভে ফুঁসছে সবাই
এ ঘটনার প্রতিবাদে আয়োজিত মানববন্ধনে প্রায় তিন শতাধিক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। তারা এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধান শিক্ষকের বিচার দাবি করেছেন। 

শামীমের মা শিরিনা বেগম বলেন, আমার স্বামী মইরা গেছে। আমি অনেক কষ্ট করে ভাইয়ের বাড়িতে থেকে পোলাডারে পড়াইতাছিলাম। কিন্তু স্যার আমার পোলাডার সর্বনাশ কইরা দিছে। আমি ওই স্যারের বিচার চাই।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, সরকার দেশে শতভাগ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে নানামুখী প্রচেষ্টা করছে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে শিক্ষা ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। আর ঘাগড়া দক্ষিণপাড়া ফজলুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল হক টাকা ছাড়া কিছু বোঝেনা। হতদরিদ্র ও এতিম শিক্ষার্থী শামীমের আর্তনাদেও সে অতিরিক্ত এক হাজার টাকার জন্য প্রবেশপত্র দেয়নি। যার কারণে কোমলমতি এ শিক্ষার্থী পরীক্ষার হলে বসতে না পেয়ে জীবনে হোঁচট খেল। নুরুল হকের এমন কর্মকাণ্ডের জন্য একজন ছাত্রের দশ বছরের স্বপ্ন-সাধনা দুমড়েমুচড়ে গেল, এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার হতে হবে।
 
মানববন্ধনে হাতিবান্ধা ইউপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আকবর আলী, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন শেরপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মানিক মিয়া, সহ-সভাপতি আমিনুল ইসলাম রাজু, সৃষ্টি হিউম্যান রাইটস সোসাইটির জেলা সভাপতি আলমগীর আল আমিন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আজকের তারণ্যের সভাপতি রবিউল ইসলাম রতন, বাংলাদেশ জাসদ শেরপুর জেলা শাখার সহ সভাপতি আবুল কালাম আযাদ, হাতিবান্ধা ৮ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মহসিন আলী, জুলগাঁও পুরাতন মসজিদের সদস্য রবিন মিয়া, শিক্ষার্থীর মা মামা বকুল মিয়া, আরিফ হোসেন ও মা শিরিনা বেগমসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। 

উবায়দুল হক/এমএএস