নওগাঁর পোরশা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্ষের মেডিকেল অফিসার ডা. ফরিদ এইচ খান। টানা তিন ঘণ্টা রাত্রিকালীন ডিউটি করে ক্লান্ত অবস্থায় তিনি যখন বিশ্রাম কক্ষে ঢুকেছেন ঠিক সেই মুহূর্তে রাত সাড়ে ১১টায় ‘মৃত’ এক শিশুকে আনা হলো হাসপাতালে। শ্বাস-প্রশ্বাসহীন নবজাতক শিশুটিকে দেখা মাত্রই এসএসএমও’কে আম্বু ব্যাগ দিয়ে বাতাস দেওয়ার দায়িত্ব দিলেন। শুরু করলেন শিশুটির বুকে চাপ দিয়ে হৃদপিণ্ডে উদ্দীপনা দেওয়া। প্রায় ৪০ মিনিটের প্রচেষ্টায় শিশুটির শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলো। 

গত শুক্রবার (৫ মে) রাতে এমনই এক লোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন ডা. ফরিদ এইচ খান। বিষয়টি নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি পোস্ট করেছেন তিনি। এ ঘটনায় নিজের কর্মস্থলসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশংসায় ভাসছেন ডা. ফরিদ এইচ খান। শনিবার (৬ মে) রাতে ডা. ফরিদের অভিজ্ঞতার বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ফেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকেও পোস্ট করা হয়। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ফেসবুক পেজের ওই পোস্টে উল্লেখ করা হয়, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পোরশা, নওগাঁতে নাইট ডিউটি করতে আসেন মেডিকেল অফিসার ডা. ফরিদ। ডিউটিতে আসার পর থেকেই একের পর এক রোগী আসছিল। কেউ মারামারির রোগী, কেউ এক্সিডেন্ডের, কেউ বিষ খেয়েছে, কারো ডায়রিয়া। রোগী দেখা শেষ করে একটু রেস্টের জন্য রুমে প্রবেশ করলেন আর অমনি ফোন আসলো, স্যার তাড়াতাড়ি আসেন। একটা মৃত বাচ্চা এসেছে। দেখে যান। ডা. ফরিদ তড়িঘড়ি করে গিয়ে দেখেন আসলেই বাচ্চার জীবনের চিহ্ন নেই। শেষ চেষ্টা হিসেবে মাহমুদকে (এসএসএমও) আম্বু ব্যাগ দিয়ে বাতাস দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে তিনি শিশুর বুকে চাপ দিয়ে হৃদপিণ্ডকে উদ্দীপনা দেওয়া শুরু করেন। সঙ্গে নার্স ও মিডওয়াইফ তাদের সবটুকু সাপোর্ট দিয়ে সাহায্য করতে লাগলেন। সিপিআর দিতে দিতে যখন দেখা যাচ্ছে কিছুই হচ্ছে না তখন অনেকেই বলতে লাগলো শুধু শুধু চেষ্টা করে লাভ নেই। তবুও তাদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। এভাবে প্রায় ৩০-৪০ মিনিট সিপিআর দেওয়ার পর বাচ্চা জোরে একটা শ্বাস নিলো এবং হার্ট বিটসহ সব আল্লাহর রহমতে ফিরে এলো। এরপরে যখন রক্তে অক্সিজেনের ঘনত্বসহ সব কিছু মেইনটেইন হচ্ছিল তখন বাকি চিকিৎসা দিয়ে বাচ্চাটিকে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে রাজশাহী পাঠিয়ে দেওয়া হলো। 

গ্রামে গঞ্জে বাসায় বাসায় এখনো অহরহ নরমাল ডেলিভারির নামে এমনভাবে বাচ্চা মারা যাচ্ছে তা খেয়াল রাখতে হবে। বাসায় যদি ডেলিভারিতে বেশি সময় লাগে তাহলে বাসাতে আর চেষ্টা না করাই ভালো। এখন সকল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্সপার্ট মিডওয়াইফ রয়েছেন। যারা নরমাল ডেলিভারি করাতে এক্সপার্ট। বাচ্চাটি রাজশাহী মেডিকেলে এখন আগের থেকে অনেকটা সুস্থ আছে। সবাই বাচ্চাটির জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করবেন।’

ডা. ফরিদের ফেসুবক পোস্টের কমেন্টে মৃত্তিকা রাজিব মিম নামে একজন লিখেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ সহায় হয়েছেন। আর ডাক্তার আল্লাহর ওপর ভরসা রাখেন বলে আল্লাহ নিরাশ করেন না। সময় আর ধৈর্যকে বরণ করলে আল্লাহ ভালো কিছুই রাখেন। এ রকম মানবিক ডাক্তারের কারণেও বেঁচে যায় হাজারো প্রাণ। আল্লাহ আপনার ভালো করুক।’

এম এ সবুজ পাটোয়ারী নামে আরেকজন লিখেছেন,‘আপনার অনবদ্য প্রচেষ্টা দেখে সত্যি অনেক ভালো লাগে। আপনি হাল না ছাড়া নাবিক। আপনার এই কর্মপ্রচেষ্টা সব সময় অব্যাহত থাকুক। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে উত্তম জাজা দান করুক।’

ওই রাতের অভিজ্ঞতার বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. ফরিদ এইচ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, রংপুর মেডিকেলে পড়াশোনা করা অবস্থায় আইসিইউতে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। সেই সময়গুলোতে শ্বাস-প্রশ্বাসহীন অনেক প্রাপ্তবয়স্ক রোগীকে এভাবে বাঁচানো সম্ভব হতো। সেখানে একবার শিশুর ক্ষেত্রে এই চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলাম। মনের ভেতর একটা জোর ছিল। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে শুক্রবার রাতে জোর চেষ্টা চালিয়েছি এবং সবশেষে সফল হয়েছি। শিশুটির শ্বাস প্রশ্বাস ফিরিয়ে আনাটা আমার জীবনের অনেক বড় একটা স্বার্থকতা।

তিনি বলেন, অনভিজ্ঞ কাউকে দিয়ে নরমাল ডেলিভারি করার সময় শিশুটির দীর্ঘক্ষণ শ্বাস-প্রশ্বাস আটকে ছিল। তার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক অবস্থায় আনার পর যাবতীয় অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে ওই রাতেই রামেকে পাঠানো হয়। বর্তমানে সেখানে ওই শিশু সুস্থ অবস্থায় আছে। তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বাড়িতে ফিরবে ওই শিশু। এমন দুর্ঘটনা এড়াতে নরমাল ডেলিভারিতে প্রত্যেককে মিডওয়াইফদের সহযোগিতা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

উল্লেখ্য, ডা. ফরিদ এইচ খান নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার খট্টেশ্বর ইউনিয়নের দাউদপুর গ্রামের কৃষক মোকলেছুর রহমানের ছেলে। রাণীনগর থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ২০১৭ সালে এমবিবিএস পাস করেন তিনি। এরপর ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএস রেসিডেন্স কোর্স করেন। ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নওগাঁর পোরশা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন ডা. ফরিদ এইচ খান।

আরএআর