দেশের শস্য ভান্ডার হিসেবে পরিচিত দিনাজপুর। জেলার মাঠে মাঠে শোভা পাচ্ছে সোনালি বোরো ধান। কৃষকরা ধান কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। গত বছরের তুলনায় এবার ধানের বাম্পার ফলনের পরও কাঙ্ক্ষিত মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারছেন না কৃষকরা। হাট-বাজারে ধানের দাম কম থাকায় প্রতি মণ নতুন ধান বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকায়। তাই ভালো ফলনেও হাসি নেই কৃষকের মনে।

জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ। বাতাসে দোল খাচ্ছে বোরোর সোনালি শীষ। সোনালি ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষকরা। কেউ আঁটি বেঁধে ধানের বোঝা কাঁধে করে, কেউ ভ্যানে কেউ গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে আবার কেউ রাস্তার উপর খোলা মাঠে ধান শুকাতে ব্যস্তসময় পার করছে।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৭১ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়। তবে চাষ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। জেলায় নতুন জাতের জিরাশাইল ৯০, জিরা ব্রি-৮৯, ব্রি-৯২, উফসি-২৯ ও ব্রি-২৮, ব্রি ২৯ জাতের ধান বেশি চাষ হয়েছে।

দিনাজপুর চিরিরবন্দর উপজেলার কৃষক আজগর আলি পোস্টকে বলেন, এবার ধান বেশি লাগাতে পারি নাই দুই বিঘা জমিতে বর্গা নিয়ে লাগিয়েছি। ধানের ফলন বিঘা প্রতি ৩২ থেকে ৩৩ মণ। বর্তমান ধান বাজরে বিক্রি করলাম ৯০০ টাকা মণ। এক বিঘা জমিতে বোরো ধানের উৎপাদন খরচ প্রায় ৩০ হাজার টাকা তাহলে থাকে কি আর। এজন্য ধান আবাদ করি কৃষকের লাভ লসও নাই। ধানের দামটা যদি ১৩শ টাকা মণ থাকত তাহলে কৃষক কিছুটা লাভবান হত।

একই এলাকার কৃষক আইয়বুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবার ৮ বিঘা জমিতে বোরো জাতের বিভিন্ন ধান লাগিয়েছি। এর মধ্যে ২৮, মিনিকেট ৯০ জিরা লাগিয়েছি। এর মধ্য ২৮ ধান বিক্রি করেছি মাত্র ৯৫০ টাকা মণ। এবার তো সব কিছুর দাম বেশি গতবছর এক বিঘা জমিতে পানির খরা ছিল দুই হাজার এবার তিন হাজার। এক বস্তা ডেব সার ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা ছিল এখন ১২০০ টাকা। এক বিঘা জমির ধান কাটতে লাগছে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। সব জিনিসের দাম বেশি হয় কিন্তু ধানের দাম বাড়ে না। তাহলে বলেন, কিভাবে ধান আবাদ করে লাভবান হব আমরা। ধান আবাদ করতে হয় পেটের দায়ে কারণ বাড়ির ভাত গরুর খাবার এতটুকুর জন্য আমাদের কত কষ্ট হয়।

খানসাম উপজেলার কৃষক রবিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বোরো জাতের ২৮ ধান তিনি বিঘা জমিতে লাগিয়েছি। গত বছরের তুলনায় এবার তো সব কিছুর দাম বেশি সার থেকে শুরু করে সেচের পানির সহ দাম বেশি। তিন বিঘা জমি থেকে ধান ঘরে তুলতে প্রায় ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আমর বিঘা প্রতি ফলন হয়েছে ৩০ থেকে ৩২ মণ। ধান বিক্রি করিছি ৯০০ টাকা মণ দরে তাহলে আমাদের কি থাকে আর ধান আবাদ করে।

সদর উপজেলা কৃষক শফিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, জিরা শাইল জাতের নতুন জাতের চিকন ধান লাগিয়েছি ৪ বিঘা জমিতে। ভাবছিলাম চিকন ধানের দাম বেশি হবে। কিন্তু বাজারে চিকন ধানের দাম ১২-১৩শ টাকা মণ। ধানের উৎপাদন খরচ বাড়লেও দামের দাম বাড়েনি। লস না হলেও লাভ হবে না ধান আবাদ করে।

নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক এক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কৃষকরা যদি ধান আবাদ করে লাভবান হওয়ার চিন্তা করত তাহলে ধান আবাদ করাই বাদ দিয়ে দিত। কারণ বর্তমান এক বিঘা জমি বর্গা নিতে হলে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা লাগে, সেচের খরচ তিন হাজার টাকা,সার, কিটনাশক, শ্রমিকের মুজুরি সব মিলে হিসেব করে দেখা যাচ্ছে এক বিঘা জমিতে বোর ধানের উৎপাদন খরচ প্রায় ৩০ হাজার টাকা। তাহলে কৃষকরা ধান কয় হাজার টাকা বিক্রি করবে? গতকাল রোববার থেকে বেশি দাম দিয়ে সরকার ধান কেনা শুরু করছে কিন্তু কয়জন কৃষক সরকারকে ধান দিতে পারবে। আমার কৃষকদের উচ্চ ফলন জাতের নতুন ধান লাগানোর পারমর্শ দিচ্ছি যাতে কৃষকরা লাভবান হতে পারে।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নূরুজ্জামান বলেন, চলতি মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৭১ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়। তবে চাষ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। সবে মাত্র এই জেলায় ধান কাটা মাড়াইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। চলতি মাসের শেষ দিকে ইরি বোরো ধান কাটা মাড়াই শেষ হবে।

তিনি আরও বলেন, মৌসুমের শুরুতে কৃষি বিভাগ সরকারি প্রণোদনার আওতায় আউশ ধানের বীজ বিতরণ করেছে। পাশাপাশি এসব ধান চাষে কৃষকদের বিনামূল্যে সার ও কীটনাশকও দেয়া হয়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি বছর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে। বড় ধরনের ঝড়, বৃষ্টি অথবা শিলাবৃষ্টি না হলে ভালো ধান পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আগামী ২০-২৫ দিনের ভেতর কৃষক ধান ঘরে তুলতে পারবে।

ইমরান আলী সোহাগ/আরকে