বগুড়াকে বলা হয় কৃষিযন্ত্রের প্রবেশদ্বার। বিদেশি কৃষিযন্ত্রের বাজারও এখন তার দখলে। দেশের কৃষিযন্ত্রের প্রায় ৮০ শতাংশ এখানে তৈরি হয়। একসময় বিদেশি কৃষি যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য বগুড়ার কামারশালায় নেওয়া হতো। এখন সেসব যন্ত্র বগুড়ায় তৈরি হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছোট ছোট যন্ত্র আবিষ্কার ও তৈরি করে ব্যক্তি উদ্যোগে বগুড়ায় কৃষিশিল্পের সূচনা হয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধেরও আগে। ১৯৬৪ সালে বগুড়া শহরের ফুলবাড়ি এলাকায় সাড়ে ১৪ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয় বিসিক শিল্পনগরী। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই শেষ হয়ে যায় প্লটগুলো। আবারও শুরু হয় কৃষিশিল্পের বিপ্লব।

১৯৮০ সালে উদ্যোক্তাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আরও ১৮ দশমিক ৬৭ একর জায়গা সম্প্রসারণ করা হয়। কিন্তু সেটির বরাদ্দও ১৯৯০ সালের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এভাবে দুই দফায় নির্মিত ২৩৩টি প্লটে ৮৫টি শিল্প ইউনিট গড়ে ওঠে। বিসিক শিল্পনগরীতে জায়গা সংকটের মধ্যেও ভালো মানের কারখানা উৎপাদনমুখী হয়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতির লড়াইয়ে নেমেছে। হাজারো শ্রমিকের মেধা আর শ্রমে তৈরি হচ্ছে কৃষিকাজের যন্ত্রাংশ।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে কৃষিকাজ। প্রযুক্তি ও প্রকৌশল শিল্পের বিপ্লব হয়েছে অকল্পনীয়। কৃষিশিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছে প্রায় দেড় লাখ মানুষের জীবিকা। কর্মসংস্থান হয়েছে লাখো শ্রমিকের। কৃষি যন্ত্রপাতির জাতীয় চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ হচ্ছে বগুড়া থেকে। আগে ভারত, চীন, জাপান, কোরিয়া ও ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশের কৃষিযন্ত্র আমদানি হতো। যার ৬০ শতাংশ এখন জোগান দেয় বগুড়ার তৈরি কৃষি যন্ত্রাংশ।

বগুড়া বিসিক শিল্প করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, বগুড়ায় তৈরি কৃষি যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা তুলনায় কয়েক গুণ উন্নত ও টেকসই। এর মধ্যে পিটি চেন কভার, পিটি পুলি, ডি পুলি, ফুয়েল কি, ফুয়েল পাইপ, ওয়েল ক্যাচার, গভর্নর বুশ, এসএফ পুলি, টেনশন সেট, হাউজিং ফুয়েল ট্যাংক, ফুয়েল ফিল্টার, পাম্প, ইম্পেলার, ওয়েল সিল, এয়ার ক্লিনার, সাইলেন্সার, চেইন কভার, বুশ গাইড, ওয়াশার, লায়নার, গজন পিন, গজন বুশ, হেড গ্যাসকেট, হেড সেট, বাল্ব গাইড। এসব যন্ত্রাংশ উন্নত মানের। তাই আমদানির প্রয়োজন পড়ে না।

১৯৬৪ সাল থেকে প্রায় ছয় দশকের ব্যবধানে সেই শিল্পই এখন দেশের অন্যতম বড় রফতানি খাতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এখন শুধু কৃষি যন্ত্রাংশই নয়, বিদেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অতি উন্নতমানের ভারী শিল্পের যেকোনো যন্ত্রাংশ বানানো হচ্ছে বগুড়ায়।

বিসিক কর্মকর্তারা জানান, আবাসিক ও চাষযোগ্য জমি এলাকায় শিল্প ইউনিট স্থাপন নিরুৎসাহিত করতে বগুড়া সদরের চারমাথা ছয়পুকুরিয়া এলাকায় ভারী শিল্পের জন্য ১৯৮০ সালে জমি অধিগ্রহণ করা হয়। প্রায় সাড়ে ১৫ একর জায়গায় ‘দ্বিতীয় শিল্পনগরী’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেওয়া হয়। বিসিকের পক্ষ থেকে ১৯৯৮ সালে প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয়। বহু চিঠি চালাচালির পর ২০০৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিসিকের পক্ষ থেকে ওই জায়গায় দ্বিতীয় শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয় দ্বিতীয় শিল্পনগরীতে নতুন করে ১০৪টি শিল্প ইউনিট গড়ে তোলার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অন্তত ২৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

২০১৬ সালে বগুড়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিসিকের জায়গা সংকট দূর করতে বগুড়া শহরের সাবগ্রাম এলাকায় জমি পরিদর্শন করে একটি প্রস্তাব ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সেটিও আলোর মুখ দেখেনি।

জেলায় গুঞ্জন মেটাল ওয়ার্কার্স লিমিটেড, মিল্টন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কার্স, আল মদিনা, আকবরিয়া গ্রুপ, ওয়ান ফার্মা লিমিটেডসহ বিভিন্ন নামে অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরি করে। এসব প্রতিষ্ঠানে হাজারো বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে।

বগুড়া বিসিক শিল্প মালিক সমিতি সূত্র জানায়, কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনে বগুড়ায় বর্তমানে আধুনিক ও ছোট-বড় মিলিয়ে ৭০টি নলকূপ কারখানা রয়েছে, কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন কারখানা ও ওয়ার্কশপ রয়েছে ৮০০টি, কৃষি যন্ত্রাংশ উৎপাদন কারখানা ও ওয়ার্কশপ ১২ শতাধিক এবং কৃষি যন্ত্রপাতি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ওয়ার্কশপ রয়েছে অন্তত পাঁচ হাজার।

বগুড়ায় উৎপাদিত সেচ পাম্প, ধান-গম-ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র, ডিজেল ইঞ্জিনের পিস্টন, লাইনার ইঞ্জিন ও মেশিনের খুচরা যন্ত্রাংশ সারাদেশের বাজার দখল করে আছে।

বগুড়া শহর ও শহরতলির আশপাশে রয়েছে অসংখ্য কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা। বিসিক শিল্পনগরে বর্তমানে চালু ৮৫টি শিল্প প্লটের মধ্যে ৭০টিই কৃষি যন্ত্রাংশ ও হালকা প্রকৌশল শিল্পকারখানা। এর মধ্যে নয়টি ফাউন্ড্রি কারখানায় তৈরি হচ্ছে সেচ পাম্প ও টিউবওয়েলের মতো পণ্য। ৬২টি কারখানায় তৈরি হয় কৃষি যন্ত্রাংশ ও হালকা প্রকৌশল পণ্য।

বগুড়ার সবচেয়ে বড় কারখানা মিলটন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজার রহমান মিলটন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে-বিদেশে বগুড়ায় উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রাংশের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এখানকার উৎপাদিত টিউবওয়েল সরবরাহ করা হয় দেশের নামিদামি প্রতিষ্ঠানে, যাচ্ছে বিদেশেও। ১৯৯৫ সালে ভারতে ভূগর্ভের পানি ওপরে তোলার সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প রফতানির মধ্য দিয়ে বিদেশের বাজারে প্রবেশ করে বগুড়ার কৃষিশিল্প। কয়েক বছর ধরে ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটানে টিউবওয়েল রফতানি হচ্ছে।

শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের প্রত্যন্ত এলাকার ক্রেতারা এখান থেকে কৃষি যন্ত্রাংশ কিনে নিয়ে যান। কৃষিভিত্তিক শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও নানা সমস্যার কারণে তা দ্রুত অগ্রসর হতে পারছে না। এ শিল্পে ব্যাংকঋণ বা সরকারি সহযোগিতার পরিমাণ খুবই কম। শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণেরও নেই কোনো ব্যবস্থা। যন্ত্রপাতি তৈরিতে আধুনিক সরঞ্জাম পেলে এবং কারিগরদের প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

বগুড়া বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল মালেক আকন্দ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পোশাক কারখানার চেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে ফাউন্ড্রি শিল্প। একই সঙ্গে এই শিল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। বগুড়ার বিসিককে সম্প্রসারণে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।

বগুড়া চেম্বারের সভাপতি মাছুদুর রহমান মিলন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সারাদেশে কৃষি যন্ত্রাংশের ৮০ ভাগের জোগানদাতা বগুড়া। ফাউন্ড্রি ও মেটাল শিল্পমালিকদের আশঙ্কা দ্বিতীয় শিল্পনগরী স্থাপন প্রকল্প ব্যর্থ হলে সম্ভাবনাময় এ শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। ফাউন্ড্রি, কৃষি যন্ত্রাংশ ও মেটাল শিল্পের চাহিদা বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে জমির চাহিদা। তাই দ্বিতীয় শিল্পনগরী গড়ে তোলা ছাড়া উপায় নেই। যদিও সরকারিভাবে বগুড়ায় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে সমস্যা থাকবে না।

বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (আরডিএ) গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে স্থানীয় ও আমদানি করা কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের বার্ষিক বাজারের পরিমাণ প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি দেশীয়। দেশের ৮০ শতাংশ চাহিদার বেশি পূরণ করে বগুড়া। এখানে প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি তৈরি হয়। এসব যন্ত্রপাতি তৈরিতে বগুড়ায় গড়ে উঠেছে উন্নতমানের ফাউন্ড্রি শিল্প। ভারত, চীনও প্রথমে ফাউন্ড্রি শিল্পকে উন্নত করে ভারী শিল্পের প্রসারে পৌঁছেছে। এই ধারায় কৃষি যন্ত্রপাতির বাজারকে আরও সমৃদ্ধ করতে বগুড়ায় ফাউন্ড্রি শিল্পের ব্যাপ্তি বাড়ানো হয়েছে।

এনএ/এএম