বদরুল হায়দার বেপারীর প্রতিদিনের বেশিরভাগ সময় কাটে কেঁচোর সঙ্গে। কারণ তার খামারে কেঁচোর মলত্যাগে তৈরি হয় ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার। সার উৎপাদন করে তিনি পেয়েছেন জাতীয়ভাবে স্বীকৃতিও। এই কেঁচো সার উৎপাদন করে দিন বদলের স্বপ্ন দেখেন বদরুল।

জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় উল্লেখযোগ্য কাজ করা ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার সরকারি সহায়তায় দেশের কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে।

বদরুল হায়দার ব্যাপারী পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার চৌঠাইমহল এলাকায় অবস্থিত জাগো এগ্রো সলিউশনের স্বত্বাধিকারী। যিনি শূন্য থেকে শুরু করে বর্তমানে হয়েছেন সাবলম্বী। পাশাপাশি তার কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে এলাকার বেশ কিছু মানুষের।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিনিয়তই যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে কৃষিব্যবস্থা। সেই সঙ্গে জমিতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারে কমছে মাটির উর্বরতা। ফসলের উৎপাদন বাড়াতে প্রতিদিনই বাড়ছে রাসায়নিক সারের ব্যবহার। মাটির উর্বরতা রক্ষায় ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার অন্যতম ভূমিকা পালন করে। যা ব্যবহার করে সল্প খরচেই অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব।

এদিকে ২০১২ সালের শেষের দিকে একটি পত্রিকা থেকে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার তৈরির প্রতিবেদন পড়ে সল্প পরিসরে কাজ শুরু করেন বদরুল। ২ কেজি কেঁচো কিনে শুরু করেছিলেন তিনি। বর্তমানে ৬ শতক জায়গা ধরে গড়ে উঠেছে বদরুলের 'জাগো এগ্রো সলিউশন‍'। যেখান থেকে বস্তা প্রতি ৭৫০-৮০০ টাকায় সার বিভিন্নস্থানে বিক্রি করেন তিনি। ৭৪টি রিং এ সেখান থেকে রিং পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রতি বছর উৎপাদিত ১৫০ টন ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার বিক্রি করে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা আয় হয় বদরুলের। এই সার বিক্রি করে নিজে সাবলম্বী হবার পাশাপাশি নিজ এলাকায় তৈরি করেছেন কর্মসংস্থান। বর্তমানে জাগো এগ্রো সলিউশনে ৫ জন স্থায়ী নারী কর্মচারী কাজ করলেও ৩ জন পুরুষ কর্মচারী অস্থায়ীভাবে প্রয়োজনানুসারে কাজ করেন।

এই কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে বঙ্গবন্ধু পেশাজীবী পরিষদ কর্তৃক পুরস্কৃত করা হয়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক ১৪২৫ সহ ২০২০ সালের ২৭ জুলাই কৃষি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে প্রথমবারের মতো কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এআইপি) সন্মাননা পেয়েছেন তিনি। রাজধানীর ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে সেদিন তার হাতে এ সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়। তার সংগ্রহে রয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের পুরস্কার।

যেভাবে উৎপাদিত হয় ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার 

প্রাথমিক পর্যায়ে স্থানীয় শ্রমিকদের মাধ্যমে সংগ্রহ করা গোবর রোদে শুকিয়ে ভেঙে গ্যাস বের করে দেওয়া হয়। ১০/১২ দিন পর কলাগাছ/কচুরিপানার কুচি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় সেই গোবর। এর মধ্যে সার উৎপাদনে কাজ শুরু করে কেঁচো। দেড়/দুই মাস পর সেখান থেকে কেঁচো বের করে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় নেট পদ্ধতি। সেখান থেকে চালনিতে পরিশোধন শেষে প্যাকেজিং হয়ে বাজারজাত হয় সার।

কর্মসংস্থান হওয়া উপকারভোগী আলো রাণী মিস্ত্রী বলেন, এক ক্যারেট গোবর আমরা ৩০ টাকায় বিক্রি করি। ১৫ দিনে আমার একটি গরু থেকে এক ক্যারেট গোবর হয়। সেটা বিক্রি করলে আমার নিজের পান-তামাকের পয়সা হওয়াসহ আমার অনেকটাই উপকার হয়। আগে ঘরে বসে থাকতাম, এখন তো এখানে গোবর বিক্রির কাজটা করি। আমাদের দুই পয়সা আয় হয়, যাতে আমরা অনেক ভালো আছি।

বদরুলের খামারে আট বছর ধরে কাজ করছেন বৃদ্ধ শ্রমিক মুকুল রানী মালি। নয় হাজার টাকা বেতনে সারাদিন বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে একটু একটু করে সার তৈরি করতে কেঁচোকে সহযোগিতা করেন তিনি। সার উৎপাদন থেকে প্যাকেটজাত হয়ে বিক্রি পর্যন্ত সারাদিন বিভিন্ন কাজ তিনিই করেন।

নারী শ্রমিক তৃপ্তি মিস্ত্রি বলেন, সেদিন অল্প থেকে শুরু করে আজ খামারের বয়স প্রায় আট বছর হয়ে গেছে। আমরা আশেপাশে যেসব গরিব লোক আছি তারা এই খামারে কাজ করে ভালো আছি। এখান থেকে আমাদের যা আয় হয় তাতে ঘরে কিছু খরচ, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচসহ নিজের কিছু কেনাকাটা সবই মোটামুটি হয়ে যায়। টাকার জন্য স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না। প্রতিবছর কার্তিক মাসের দিকে কেঁচোর ডিমগুলো ভালো দেখতে পাওয়া যায়। সেগুলো বলট্রাপে গোবর দিয়ে অনেকদিন রেখে দিলে কেঁচোর বাচ্চা ফোঁটার পর আমরা তাদের সেডে নামিয়ে দেই। সেখানে তাদের খাবার হিসেবে গোবর দিয়ে তার উপরে কচুরিপানা বা কলা গাছের কুচি ও পানি দিয়ে আটকে দেই। সেই খাবার খেয়ে যে মলত্যাগ করে সেটাই আমরা কেঁচো সার হিসেবে বাজারে বিক্রি করি। সার যদি বিক্রি না হতো আমরা তো এখানে কাজ করতে পারতাম না। সার ব্যবহারে উপকার হয় বিধায় ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এ সার কিনে নিয়ে যায়। বিভিন্ন এলাকায় সবাই এই কাজ করলে আমাদের মত গরিব লোকেরা একটু ভালো থাকতে পারবে।

জাগো এগ্রো সলিউশন এর স্বত্বাধিকারী বদরুল হায়দার ব্যাপারী বলেন, জৈব সারের মধ্যে সারা পৃথিবীতেই এখন ভার্মি কম্পোস্ট একটি সমাদৃত সার। এখানে প্রয়োজনীয় প্রায় সব উপাদানগুলো থাকে বিধায় এটি ব্যাপক সম্ভাবনার একটি জায়গা। ৬ শতাংশ জায়গার উপরে প্রতিষ্ঠিত খামারটিতে আমরা মাসে ১৩ থেকে ১৪ টন সার উৎপাদন করে বাজারজাত করে থাকি। সার উৎপাদনে মূল যেটা কাজ করে সেটা হচ্ছে কেঁচোর মল ত্যাগ। গরুর গোবর খেয়ে কেঁচো মোটামুটি ৯৫ শতাংশ শেষ করে ফেললে চা পাতার মতো দানাদানা সার তৈরি হয়। এখানে তিন ধরনের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে একটা হলো, যে সকল খামার থেকে গরুর খামারিরা গোবর নিয়ে আসে তাদেরকে আমরা ক্যারেট প্রতি ৩০ টাকা দেই। আর দূর থেকে আমার যে গোবর সংগ্রহ করতে হয় তাদেরকে প্রতি ক্যারেটের ১০ টাকা দেওয়া হয়। আমার খামারে নারী ও পুরুষ দুই শ্রেণির শ্রমিকরাই কাজ করে। আর নারী শ্রমিকরা মূলত খামারের মধ্যেই কাজ করে, আর পুরুষ শ্রমিকরা কাঁচা গোবর, কলাগাছ ও কচুরিপানা দূরবর্তী স্থান ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে সংগ্রহের কাজ করে।

তিনি আরও বলেন, ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার আসলে ব্যাপক সম্ভবনার একটি জায়গা। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। আমার গ্রাম, উপজেলা, জেলাসহ এখানে তিন শ্রেণির ক্রেতা রয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে প্রচুর পরিমাণে ঢাকায় ইভেন্ট করেছি। ছাদ বাগান চাষিদের একত্রিত করে গাছের চারা, বীজ কাটিংসহ কেঁচো সার উপহার দিয়েছি। আসলে আমার উদ্দেশ্য ছিল কেঁচো সারকে প্রমোট করা। আমার জীবনে আমাকে বিভিন্ন অবস্থান থেকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে আমরা দেখেছি রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেছে। মাটি এখন আর সেই পূর্বের মতো আউটপুট দিতে পারে না। সেই জায়গা থেকে আমরা মাটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের যদি আমরা চিন্তা করি, আমাদের প্রাণ প্রকৃতিকে ঠিক রাখতে চাই এবং আমরা যদি গ্লোবাল ওয়ার্মিংটাকে সহনশীল পর্যায়ে রাখতে চাই, সেক্ষেত্রে জৈব সার হিসেবে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. নজরুল ইসলাম শিকদার জানান, জৈব পদার্থ হচ্ছে মাটির প্রাণ। স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য মাটিতে শতকরা ৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকা জরুরি প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে কৃষি জমির মাটিতে সেই পরিমাণ জৈব পদার্থ নেই। পিরোজপুরসহ সারা দেশেই মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় উল্ল্যেখযোগ্য কাজ করা ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার সরকারি সহায়তায় কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে। এছাড়া জমির স্বাস্থ্য রক্ষা না করলে কৃষি উন্নয়ন একসময় মুখ থুবড়ে পড়বে। এই ভার্মি কম্পোস্টকে একটি শিল্পে রূপান্তরিত করার জন্য সামাজিক আন্দোলনে গড়ে তুলতে হবে। পিরোজপুর জেলা থেকে ২০২০ সালে এআইপি হিসেবে কৃষি মন্ত্রীর কাছ থেকে সম্মাননা গ্রহণ করেছেন বদরুল হায়দার বেপারী। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনকারীদের মাঝে আমরা কৃষি বিভাগ থেকে প্রণোদনা দিচ্ছি। জৈব পদার্থ হিসেবে ভার্মিকম্পোস্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। প্রতিনিয়ত চাষীদের আগ্রহ বাড়ায় এই সারের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। এই লাভজনক ব্যবসার মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। কৃষি ক্ষেত্র উন্নয়ন ও সামাজিক উন্নয়ন এবং কৃষকের আর্থসামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে ভার্মি কম্পোস্ট বা কঁঁচো সারকে শিল্পে রূপান্তরিত করতে হবে।

আবীর হাসান/আরকে