রুবি বেগম

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের সর্দারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোছা. রুবি বেগম (৫০)। ২০০৪ সালে তার স্বামী সামছুল সর্দার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর দুই ছেলেকে নিয়ে মহাবিপদে পড়েন রুবি। সে সময় বড় ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে ও ছোট ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তো। সংসারে উপার্জন করার মতো কেউ ছিল না। স্বামীর হঠাৎ মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে পড়েন। তবে হার মানেননি তিনি। শত কষ্টেও দুই ছেলেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। 

রুবি বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেদিন আমার কাছে ১০টি টাকাও ছিল না। সংসার কীভাবে চলবে, দুই ছেলেকে  নিয়ে কীভাবে বাঁচবো সেই চিন্তায় প্রায় পাগল হয়ে গেছিলাম। কতদিন যে না খেয়ে ছিলাম তা বলে শেষ করতে পারব না। নিজে না খেয়ে ছেলে দুইটাকে খাওয়াইছি আর পড়াশোনা করাইছি। শ্বশুরের বাঁশ বাগান থেকে বাঁশ বিক্রি করেও লেখাপড়ার খরচ দিয়েছি। বাবার বাড়ি থেকেও বার বার হাত পেতে টাকা নিয়েছি তাদের জন্য। আজ ছেলে দুইটা আমার প্রতিষ্ঠিত। 

তিনি বলেন, আল্লাহপাক দীর্ঘ জীবনের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আজ আমার বড় ছেলে পুলিশের এএসআই এবং ছোট ছেলে বিজিবিতে সৈনিক হিসেবে কর্মরত আছে। আমার দুঃখ দূর হয়েছে, সমাজে সবাই এখন আমাকে সম্মান করে। স্বামীর মৃত্যুর পর আমাদের থাকার মতো কোনো ঘর ছিল না। স্বামী হারানোর পর মনে মনে আমি প্রতিজ্ঞা করি যেকোনো মূল্যে আমার ছেলে দুইটাকে মানুষের মতো মানুষ করবো। সেই অতীতের কথা মনে পড়লে আজও চোখ দিয়ে পানি আসে।

রুবি বেগম বলেন, আমি চার বছর আগে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হই। বাংলাদেশে অনেক টাকা ব্যয় করে সুস্থ না হওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিই। সেখানে আমার ছেলে ১১-১২ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। এখন আমি সুস্থ। যা আমার জীবনের বিরাট পাওয়া। মনে করি আমি একজন সফল মা। আমার প্রচেষ্টা আর আল্লাহ পাকের রহমতে আমার ছেলেদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। আল্লাহপাক যেন সন্তানদেরকে দীর্ঘ জীবন দান করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রুবি বেগমের স্বামী একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। জেলা শহরে দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন। বেশ ভালোই চলছিল তাদের সংসার জীবন। হঠাৎ ক্যান্সার কেড়ে নেয় স্বামীর জীবন। অসহায় হয়ে ফিরে আসেন গ্রামে। গ্রামে থাকার মতো তাদের কোনো ঘর ছিল না। রুবি বেগম সন্তানদেরকে নিয়ে চলে যান বাবার বাড়ি। সেখানে কিছু দিন থাকার পর চলে আসেন শ্বশুরবাড়িতে। এসে ছোট একটি ঘর তোলেন। অনেক কষ্ট আর অভাবের মধ্য দিয়ে চলে তিন সদস্যের জীবন। অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে ছেলেকে পড়াশোনা করান স্থানীয় একটি স্কুলে। সেখান থেকে বড়  ছেলে মো. ওবাইদুর হক রুবেল এসএসসি পাস করার পর যোগ দেন পুলিশের চাকরিতে। পরে ওবায়দুল হক প্রোমোশন নিয়ে পুলিশের এএসআই হন। কয়েক বছরের ব্যবধানে ছোট ছেলে মো. সোহেল রানাও বিজিবিতে যোগ দেন। ধীরে ধীরে সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আসে। রুবি বেগমের স্বপ্ন পূরণ হয়। সুখে শান্তিতে বসবাস করছে তারা। বর্তমানে বড় ছেলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দেশের বাহিরে আছেন।

রুবির প্রতিবেশী মেহেরা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার চোখের সামনে রুবির জীবনে যে দুঃখ-কষ্ট  দেখেছি তা বলে শেষ করতে পারব না। সন্তানের জন্য মানুষ কষ্ট করে ঠিকই তবে এমন কষ্ট করার মহিলা আমি কখনো দেখি নাই। তার কষ্ট আজ সার্থক হয়েছে। দুই ছেলেই এখন সরকারি চাকরি করছে। ভালোই চলছে তাদের সংসার। 

বড় ছেলে মো. ওবাইদুর হক রুবেল মুঠোফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখনি আমার বাবা মারা যান। আমি মনে করেছিলাম আমার লেখাপড়া আর হবে না। জীবনে ভালো কিছু করতে পারবো না। কিন্তু আমার মা কখনোই হাল ছাড়েননি। আমাকে বরাবরই সাহস দিয়ে ধৈর্য ধরতে বলতেন। আমি দেখেছি কষ্ট কত ভয়ানক হয়। আমি দেখেছি অভাব কত বড় ভয়াবহ হয়। তবু আমার মা আমাদেরকে মানুষ করতে হাল ছাড়েননি। আজ আমরা দুই ভাই সরকারি চাকরি করার পেছনে শুধু আমার মায়ের অবদান। আমি চাই প্রত্যেক ঘরে যেন এ রকম সাহসী মা থাকে। আমাদের সফল মা বেঁচে থাকুক অনন্তকাল। আমরা দুই ভাই তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল বাতেন সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছেলে দুটি শিশুকালে বাবাকে হারান। তাদের মা অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়ে ছিলেন। আজ দুই ভাই সরকারি চাকরি করছেন। তাদের সংসারে এখন আর কোনো অভাব অনটন নেই। সমাজে এ রকম মায়ের খুবই প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

আরএআর