ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার উমেদপুর ইউনিয়নের বাহির রয়েড়া গ্রামের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা হেমেলা খাতুন। পাঁচ সন্তানের জননী তিনি। ৯ মাস আগে ভ্যানচালক স্বামী ইয়াজুল ইসলামের অকাল মৃত্যুতে যেন আকাশ ভেঙে পড়ে তার ওপর। সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে হেমেলার কাঁধে। তবে দমে যাননি তিনি। শত কষ্টেও চালিয়ে নিচ্ছেন সংসার। পড়াশোনা করাচ্ছেন চার সন্তানকে। 

সরেজমিনে হেমেলা খাতুনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, হেমেলা বাড়ির উঠানে বসে ঘাস কাটছেন। তা আবার ছাগল-গরুকে খেতে দিচ্ছেন। ছাগল-গরুর খাবার দেওয়া শেষ হলে হাতের অন্যান্য কাজ শেষে সেলাই করছেন গ্রাম্য নকশি কাঁথা। গ্রামের মেয়েদের কাপড়ও বানাচ্ছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের জমিতে চাষাবাদ করার পাশাপাশি বাড়িতে গরু -ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া দুই মেয়েসহ চার সন্তানের পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছেন তিনি। 

হেমেলা খাতুনের শাশুড়ি আছিরণ নেছা ঢাকা পোস্টকে জানান, সাত সন্তানের মধ্যে ইয়াজুল বড়। ছেলের বউয়ের এতো কষ্ট দেখে ছেলের মৃত্যুর কথা ভুলেই গেছি। ছেলেদের সংসার আলাদা হওয়ায় সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল ইয়াজুল। জীবনে অনেক কষ্ট করে ছোট ভাইদের লেখাপড়া শিখিয়েছে। আবার এখন তার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখাচ্ছিল। নাতিরা (ছেলের সন্তান) খুব মেধাবী। সবার সহযোগিতা পেলে হয়তো পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারবে তারা।

হেমেলা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার শ্বশুরের সাত সন্তানের মধ্যে স্বামী ইয়াজুল ইসলাম বড় ছিলেন। হতদরিদ্র দিনমজুর বাবার সংসারে ছোটবেলা থেকেই কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে (ইয়াজুল ইসলাম)। এক বেলা খাবার জুটেছে কিংবা জুটেনি তার। বিয়ের পর সংসার থেকে আলাদা হই। নিজের সংসারও বড় হতে লাগলো। আমাদের ঘরে একে একে চার মেয়ে এক ছেলে সন্তানের জন্ম হলো। গ্রামের রাস্তা-ঘাট ভালো ছিল না। শৈলকুপা উপজেলা শহরে প্যাডেলের রিকশা-ভ্যান চালিয়ে, অন্যের জমি বর্গা নিয়ে, গরু-ছাগল পালন করে মোটামুটি সংসার চলছিল। সংসারে অভাব থাকলেও ছেলেমেয়েদের নিয়ে আকাশ ভরা স্বপ্ন ছিল আমাদের।

তিনি বলেন, বড় মেয়ে রিমা খাতুন এইচএসসি পাসের পর বিয়ে হয়ে গেছে। ঢাকায় জামাই-মেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মেজো মেয়ে কানিজা খাতুন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। সেজো মেয়ে (তৃতীয় সন্তান) তাছলিমা খাতুন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। ছোট মেয়ে চাঁদনী খাতুন এইচএসসি পাস করেছে। একমাত্র ছেলে আরাফাত ইসলাম সবার ছোট। বয়স ১৪ বছর। স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় হাফেজি পড়ছে। 

হেমেলা খাতুন বলেন, ওদের বাবার দিনমজুরি করে, ভ্যান চালিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এজন্য সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাটারিচালিত একটি ইজিবাইক কিনেছিল। সংসারের সব কিছু ঠিক ঠাকই চলছিল। সেদিন ছিল ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট। সকাল সাড়ে ৮টার উঠানে রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। বারান্দায় সুইচ বন্ধ করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে লুটিয়ে পড়েন ইয়াজুল। ওখানে ইজিবাইকের ব্যাটারিতে চার্জ দেওয়া ছিল। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। 

হেমেলা খাতুন বলেন, নিমিষেই নিভে গেল সুখের প্রদীপ। স্বামী মারা গেছেন প্রায় ৯ মাস হলো। তার স্বপ্ন ছিল মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবেন। বড় বড় সরকারি অফিসার বানাবেন। সবকিছুই ঠিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ মাঝপথে আমাকে রেখে তিনি চলে গেলেন? স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের জমিতে চাষাবাদ করার পাশাপাশি বাড়িতে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েদের পড়ালেখা যেন মাঝ পথে আটকে না যায় সেই চেষ্টা করছি। 

হেমেলার দ্বিতীয় মেয়ে ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কানিজা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর মা একা একা আমাদের সংসার চালানোর পাশাপাশি পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছে। এই কষ্ট বা অনুভূতিটা কাউকে বলার মতো নয়। আগেও সংসারে অভাব ছিল, কষ্ট ছিল। কিন্তু তখন বাবা ছিল। যার কারণে বেশি চিন্তা করতে হয়নি। এখন বাবা নেই যার ফলে পরিবারের অভাব, কষ্ট বেড়ে তো গেছেই, সেই সঙ্গে আমাদের অনেক চিন্তাও বেড়ে গেছে। কীভাবে লেখাপড়া শেষ করব? 

তিনি বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর একজন সরকারি চাকরিজীবী আমাদের দুই বোনকে প্রতিমাসের এক তারিখে তিন হাজার করে টাকা দেন পড়ালেখার খরচ বাবদ। এছাড়াও ঢাকা থেকে একজন এক লাখ টাকা দিয়েছেন আমাদের পড়ালেখা করার জন্য। আমরা সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা এখনো পাইনি। বাবার স্বপ্ন ছিল আমরা লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হব, সরকারি বড় অফিসার হব। আমাদের পড়ালেখা শেষের দিকে। আমরাও চেষ্টা করছি বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে। এর জন্য সরকারসহ সমাজের সকল মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন।

উমেদপুর ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. রুজদার আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গরিব মানুষ হয়েও ইয়াজুল ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাচ্ছিল। ওই অভাবের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল সে। ইয়াজুল মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী এখন সংসারের হাল ধরেছে। মেয়েদের যেন লেখাপড়ার কোনো সমস্যা না হয় এজন্য ইয়াজুলের স্ত্রী রাতদিন পরিশ্রম করেন। সমাজের অন্য ১০ জন নারীর থেকে আলাদা তিনি। তার চোখে মুখে শুধু সন্তানদেরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে বড় করার আপ্রাণ চেষ্টা। 

তিনি বলেন, হেমেলার স্বামী মারা যাওয়ার পর বিধবা ভাতার জন্য আবেদন করেছি, এখনো হয়নি। এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদের বেশ কিছু সুবিধা তাকে দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি সরকারিভাবে যদি তাকেসহ তার মেয়েদের জন্য কিছু করা যায়, তাহলে মেধাবী ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখতে পারবে। দেশের সম্পদ হয়ে বেড়ে উঠবে।

আব্দুল্লাহ আল মামুন/আরএআর