আনোয়ারা বেগম

‘আমার একটাই ছেলে। আর কোনো সন্তান নাই। ছেলেটার বিয়ের বয়স হওয়ায় বিয়ে দিলাম। আর ভাবলাম আমরা শেষ বয়সে ছেলের বউয়ের সেবা যত্ন পাব। কিন্তু বিয়ের কিছু দিন পর ছেলের বউ আমাক আর আমার স্বামীকে দেখতে পারে না, গালিগালাজ করে, আমার চুলের মুঠি ধরে মারধর করতো, খাবার দিত না। এক সময় মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তারপর খেয়ে না খেয়ে ছিলাম দুজনে। পরে এই সাজু বাবার আশ্রমে আসি। সেটা আজ থেকে প্রায় ৫ বছর আগে।’

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার এক নিভৃতপল্লিতে গড়ে ওঠা ‘নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমের’ বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম। তিনি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার চেংমারী বেঁচাটারী গ্রামের মৃত মোক্তার হোসেনের স্ত্রী। 

একমাত্র ছেলে আনোয়ার হোসেন আনু ও ছেলের বউয়ের অবহেলা ও নির্যাতনে আনোয়ারা-মোক্তার দম্পতির ঠাঁই হয়েছিল বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে ভালোভাবেই দিন যাচ্ছিল তাদের। হঠাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মোক্তার হোসেন। ছেলে থাকার পরও বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস করছেন বিধবা আনোয়ারা বেগম।

আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘স্বামীসহ দুজনে এখানে ভালোই চলছিল আমাদের জীবন। হটাৎ স্বামী অসুস্থ হয়ে রংপুরের হাসপাতালে মারা যান। এজন্য একা একা লাগে এখানে অশান্তি লাগে। ছেলে মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে আসে কিন্ত ছেলের বউ কোনো খোঁজখবর নেয় না। ছেলে আমাকে বাড়ি নিয়া যাইতে চাইলেও বউয়ের জন্য পারে না। আমার নাতি-নাতনিগুলো আমার কথা বললেও তার মা ধরে মারে তাদেরকে। আমার ছেলেটার জন্য দোয়া সব সময় আছে, থাকবে।’

শুধু আনোয়ারা বেগম নন, তার মতো অনেক অসহায় মা-বাবা বসবাস করছেন এই নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে। চোখে মুখে যাদের বয়সের ভাঁজ, অন্তহীন বেড়াজালে বন্দি তারা। এখন শুধু পরপারের হাতছানির অপেক্ষা। অথচ এই মা-বাবা এক সময় তাদের সন্তানদের মানুষ করতে কতই না ছোটাছুটি করেছেন। তারাই আজ সন্তানের কাছে ঝরে পড়া শুকনা পাতার মতো।

সন্তানদের ঘরে জায়গা হয়নি এসব মা-বাবার। অভিমান হয় সন্তানদের প্রতি কিন্তু কোনো ক্ষোভ নেই। বুকের মধ্যে হাহাকার, বোঝা নামাবার কোনো জায়গা নেই। কখনো কষ্টের কথা মনে করে ডুকরে কাঁদেন, কখনো ভাবেন বেশ আছেন তারা।

এই বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা উপজেলার বড়ভিটা এলাকার কহিনুর বেগম। তিনি বলেন, ‘বেটা-বেটি থাকিয়াও নাই। আর ওমরাও চলিয়ার পারে না। হামার বাড়ির লোকটা যখন হাঁটাচলা ভালোভাবে করছিল তখন ছোট একটা দোকান করছিল। হাঁটাচলা বন্ধ হওয়ায় দোকানও বন্ধ হইছে। কাম না করির পাইলে তো না খেয়া থাকা লাগে। অনেক সময় না খেয়া ছিনো। তারপর এইখানে আসছি আমরা দুইজনে। এখন বাকিটা সময় এখানেই কাটাইতে হবে।’

বৃদ্ধাশ্রমটিতে আশ্রিতদের দেখাশোনা করেন উপজেলার রণচণ্ডী এলাকার মনজিলা পারভীন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বৃদ্ধদের সেবা করতে অনেক ভালো লাগে। তাদের সেবা করতে, খাওয়াইতে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে,  চলতে খুবই ভালো লাগে। যে কারণে এখানে কাজ করতে আসা। আমি মনে করি এই বৃদ্ধদের সেবাযত্ন করা মানে বাবা-মায়ের সেবাযত্ন করা। তারা ঠিকমতো খাইছে কি না, দুপুরে ঘুমানোর সময় ঠিকমতো ঘুমাইছে কিনা, ঠিকমতো ওষুধ খাইছে কি না এসব আমি দেখাশোনা করি।

‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/ মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার।’... নন্দিত কণ্ঠশিল্পী নচিকেতার এই গান শুনেই অনুপ্রাণিত হয়ে অসহায় বাবা-মায়েদের পাশে দাঁড়ানোর সংকল্প করেছিলেন বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সাজেদুর রহমান সাজু। স্বপ্ন বুননের সমাপ্তি ঘটিয়ে তা বাস্তবায়ন করেন ২০১৮ সালে। পেশায় ব্যবসায়ী সাজু কিশোরগঞ্জের বড়ভিটা ইউনিয়নের সামসুল হকের ছেলে।

কারমাইকেল কলেজ থেকে বাংলায় মাস্টার্স পাস করে নিজ গ্রামে কীটনাশকের ব্যবসা করে উপার্জিত টাকা দিয়ে নিজের জায়গায় কিশোরগঞ্জ সরকারি কলেজ সংলগ্নে পাঁচটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করেন। স্বপ্নের বৃদ্ধাশ্রমটির নাম দেন ‘নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রম’।

সাজেদুর রহমান সাজু ঢাকা পোস্টকে বলেন, সমাজের অসহায় হতদরিদ্র, ছিন্নমূল কোনো মানুষ যেন রাস্তায় পড়ে না থাকে এই জন্য আমি কাজ শুরু করি। সন্তান কর্তৃক যে সকল বাবা-মা লাঞ্ছিত হয়, সেই সকল বাবা-মাকে নিয়ে আমার এই বৃদ্ধাশ্রম। এখন পর্যন্ত ৯৭ জন বাবা-মাকে তাদের সন্তানদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। বর্তমানে এখানে ১১ জন বাবা ও ১১ জন মা রয়েছেন। 

আরএআর