ঝুলে আছে শ্যামাসুন্দরীর উন্নয়ন, বাড়ছে শঙ্কা
রংপুর মহানগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি আর যানজট নিরসনে শ্যামাসুন্দরী খালকে ঘিরে নানা প্রতিশ্রুতি-পরিকল্পনার কথা বলা হলেও বাস্তবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ঐতিহ্যবাহি শ্যামাসুন্দরী খালের উন্নয়ন প্রকল্প। বর্তমান মেয়র প্রথম মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর গত ৫ বছরে শ্যামাসুন্দরী খাল বাঁচাতে বেশকিছু সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রায় ২০০ শতাধিক দখলদার চিহ্নিত করে চালিয়েছেন উচ্ছেদ অভিযান। দফায় দফায় সচেতন মহলসহ বিভিন্ন জনকে নিয়ে হয়েছে মতবিনিময় সভা ও নানা পরিকল্পনা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে উত্থাপিত উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় আসছে বর্ষা মৌসুমকে ঘিরে বাড়ছে নগরবাসীর ক্ষোভ। কারণ দুই দফায় শ্যামাসুন্দরীর পানি উপচে ডুবেছিল নগরবাসী।
আগে বৃষ্টি হলে শহরের সব পানি শ্যামাসুন্দরী খালে গিয়ে পড়ত। বতর্মানে ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশন অনেকটা বাধার সম্মুখীন। এ কারণে নগরীতে ভারী বৃষ্টিপাত হলে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। দীর্ঘদিনেও শ্যামাসুন্দরী রক্ষা ও সংস্কারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় বাড়ছে ক্ষোভ। পৌরসভা থেকে রংপুর সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও শ্যামাসুন্দরী খাল এখন জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের স্বচ্ছ পানির এ খাল এখন দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ংকর। মশা-মাছি আর পোকা-মাকড়ের প্রজননক্ষেত্রই শুধু নয়, দখল-দূষণেও এই খাল পরিবেশের জন্য এখন মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি নগরীর কিছু জায়গায় খাল থেকে কচুরিপানা ও ময়লা-আবর্জনা তুলে খালের দুপাশে রেখে খালটি কিছুটা পরিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু মশার উপদ্রব কমেনি। বরং খাল সংস্কার ও খনন না হওয়ার কারণে আসছে বর্ষায় পুরো শহর ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন নগরবাসী।
বিজ্ঞাপন
ঘাঘট নদে উৎপত্তির পর শহরের পুরনো ১৫টি ওয়ার্ডের সবকটিকে ছুঁয়ে শ্যামাসুন্দরী খাল ১৬ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে মিশেছে খোকশাঘাঘট নদে। জলাবদ্ধতা দূর ও ম্যালেরিয়ার হাত থেকে রংপুরকে মুক্ত রাখতে পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান ও ডিমলার রাজা জানকী বল্লভ সেন ১৮৯০ সালে তার মা চৌধুরানী শ্যামাসুন্দরী দেবীর নামে খালটি পুনঃখনন করেন। ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ খালের সম্মুখে রয়েছে নগরীর কেলাবন্দের ঘাঘট নদ। সেখান থেকে শুরু করে নগরীর ধাপ পাশারীপাড়া, কেরানীপাড়া, মুন্সীপাড়া, ইঞ্জিনিয়ারপাড়া, গোমস্তাপাড়া, সেনপাড়া, মুলাটোল, তেঁতুলতলা শাপলা সেতু, নূরপুর, বৈরাগীপাড়া হয়ে মাহিগঞ্জের মরা ঘাঘটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এলাকাভেদে এর প্রস্থ ২৩ থেকে ৯০ ফুট ছিল।
রংপুর সিটি করপোরেশন ও বিভাগ হওয়ার পর থেকে নগরীতে জনসংখ্যা বেড়েছে। শ্যামাসুন্দরী খাল ঘেঁষে তৈরি হয়েছে বড় বড় অট্টালিকা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ ও আবাসিক ভবন। এসবের প্রতিদিনের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে শ্যামাসুন্দরী খালে। এতে খাল ভরাট হয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পানির প্রবাহ না থাকায় দুর্গন্ধ ছড়ানোর পাশাপাশি মশা-মাছির উপদ্রব বেড়েছে খালপাড়ে। এছাড়া অনেকে পয়োনিষ্কাশনের সংযোগ এ খালে দেওয়ায় পানি দূষিত হয়ে পড়েছে।
দীর্ঘদিন থেকে সংস্কার না করায় শ্যামাসুন্দরী খালটি নাব্যতা হারিয়েছে। এর দুই পাশ অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ায় সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে খালটি। করোনার প্রকোপ শুরুর আগে খালের উৎসমুখ থেকে মাহিগঞ্জ পাটবাড়ি পর্যন্ত খালের দুই পাশের প্রায় ১০ কিলোমিটার সংস্কারকাজ হাতে নেওয়া হয়। এর জন্য আগে রংপুর বিভাগীয় প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় হাল জরিপ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে সিটি করপোরেশন হওয়ার আগে দুটি প্রকল্পে ১২৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় শ্যামাসুন্দরীর সংস্কারে। নতুন করে আরও ১০০ কোটি টাকার নতুন একটি প্রকল্প প্রণয়ণের কাজ করা হয়েছে। শ্যামাসুন্দরী খালের পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট জেলা প্রশাসক সম্মেলনকক্ষে প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নদী বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, শিক্ষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের সমন্বয়ে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। শ্যামাসুন্দরীকে পুনরুজ্জীবিত করতে তিন ধাপে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সীমানা নির্ধারণ, পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবিত কর্মসূচির আওতায় ওই বছর ২৩ অক্টোবর নগরীর চেকপোস্ট এলাকায় সীমানা নির্ধারণ কাজের উদ্বোধন করা হয়।
পরবর্তী সময়ে স্থানীয়দের সঙ্গে আলোচনা সভাও অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সীমানা নির্ধারণসহ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। ২০২০ সালে করোনার প্রকোপ বেড়ে গেলে থমকে যায় শ্যামাসুন্দরী পুনরুজ্জীবিতকরণের কাজ। ওই বছর ২৭ সেপ্টেম্বর ১১ ঘণ্টায় ৪৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে রংপুর নগরীর প্রধান সড়ক, পাড়া-মহল্লার অলিগলিসহ বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মালামাল, খাদ্যশস্যসহ প্রায় অর্ধকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। স্থানীয়রা ঘরবাড়ি ছেড়ে গবাদি পশুসহ আশ্রয় নেয় নগরীর স্কুলগুলোতে। এরপরেও রংপুর সিটি করপোরেশনসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা শ্যামাসুন্দরী খাল নিয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেননি।
পরের বছর ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর ২৪ ঘণ্টায় ২৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলে শ্যামাসুন্দরী দিয়ে পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় নগরীতে তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ফলে পুনরায় পানিবন্দি হয়ে পড়েন নগরবাসী। পরপর দুই বছর তীব্র জলাবদ্ধতার কারণে ২০২১ সালের শেষের দিকে সিটি করপোরেশন শ্যামাসুন্দরী নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়। এজন্য ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বিকন ডিজাইন স্টুডিও নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রশাসন, প্রকৌশলী, সুশীল সমাজসহ স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে আলোচনা করে শ্যামাসুন্দরী খাল সংস্কারে স্থায়ী পরিকল্পনা নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কচ্ছপ গতিতে কাজ করায় এক বছরেও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেই আলোচনা শেষ করতে পারেনি।
সিটির ২১ নম্বর ওয়ার্ডের হাজীপাড়া চামড়াপট্টি এলাকার ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ২০১৯ সালে শ্যামাসুন্দরী খালের উন্নয়নের জন্য আমরা বাড়ি ভেঙে জায়গা ছেড়েছি। খালের পাড় থেকে গাছপালা কেটে ফেলেছি। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও খালের কোনো উন্নয়ন হয়নি। বরং আগের চেয়ে এখন অবস্থা বেশি নাজুক। ময়লা-আবর্জনার কারণে ঠিকমতো পানি প্রবাহিত হয় না। দুর্গন্ধ আর মশার উৎপাতে আমাদের ভোগান্তি বেড়েছে। আমরা চাই বর্ষার আগেই শ্যামাসুন্দরী খালের উন্নয়নকাজ শুরু হোক।
কারমাইকেল কলেজ রিভারাইন পিপল ক্লাবের সদস্য মিরাজ আহমেদ বলেন, ঘাঘটের উৎসমুখ তিস্তা নদী থেকে শ্যামাসুন্দরীকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ফলে শ্যামাসুন্দরী স্রোত হারিয়েছে। নদীটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা এখন জরুরি। এজন্য শ্যামাসুন্দরী বাঁচাতে ঘাঘটের উৎসমুখ খুলে দেওয়া, শ্যামাসুন্দরী থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা, দূষণ বন্ধ করা ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে খনন করার দাবি জানান তিনি।
শ্যামাসুন্দরী খালটির সঠিক ব্যবস্থাপনা রংপুর নগরীর সার্বিক পরিবেশ বদলে দিতে পারে বলে দাবি রংপুর ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক শহিদুল ইসলামের। তিনি বলেন, সঠিক ব্যবস্থাপনা খালটির সংস্কার করা হলে নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, আকস্মিক বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং ভূগর্ভস্থ পানির অনুপ্রবেশে শ্যামাসুন্দরী হতে পারে অতুলনীয় উৎস। নগরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনায় জলাশয়টি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। এছাড়া এটি নগরবাসীর চিত্তবিনোদনের জন্যও হতে পারে অনন্য সহায়ক।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রংপুর মহানগরের সভাপতি অধ্যক্ষ খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, পরামর্শক কমিটির দু-তিনটি সভায় আমিও উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু যে গতিতে পরামর্শক কমিটি আলোচনা সভা করছে, এতে করে কয়েক বছরেও এ খাল নিয়ে স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, পরিকল্পনা মাফিক কোনো উন্নয়নকাজ না হওয়ায় শ্যামাসুন্দরী খালটি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের ৬০ ফুট চওড়া খালটি বর্তমানে ১০ থেকে ১৫ ফুটে এসে ঠেকেছে। খালের বেশির ভাগই দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালী লোকজন। আবার কোথাও কোথাও ভরাট হয়ে গেছে ময়লা-আবর্জনায়।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শ্যামাসুন্দরী পুনরুদ্ধার কোর কমিটির সদস্য ও নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, বর্তমানে শ্যামাসুন্দরীকে বাঁচাতে হলে এতে পানি লাগবে। ৩০ বছর আগে কীভাবে পানি প্রবাহিত হতো, ঘাঘট থেকে শ্যামাসুন্দরীতে কেন পানি প্রবাহিত হচ্ছে না, কোথায় কোথায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে তা আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। বর্তমানে রংপুর শহরের আকাশ খারাপ হলে গোটা নগরী পানিতে ডুবে যাবে, যা দুই বছর থেকে আমরা বুঝতে পারছি। অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে এবং এ খালে পানির প্রবাহ যেন স্বচ্ছ থাকে সে ব্যাপারেও অধিকতর নজর দিতে হবে।
রংপুর সিটি করোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন মিঞা বলেন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান খালের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে। সেই পরিকল্পনার ভিত্তিতে প্রাক্কলন তৈরি করে তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে। বরাদ্দ আসার পর পুরোদমে খালের উন্নয়নকাজ শুরু করা সম্ভব হবে। বর্ষা সামনে রেখে জলাবদ্ধতা রোধে নগরীর ড্রেন ও শ্যামাসুন্দরী খাল পরিষ্কারের কার্যক্রম চলছে। আশা করছি জলাবদ্ধতার কারণে নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে না।
রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান বলেন, শ্যামাসুন্দরী খাল পরিকল্পিতভাবে সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। খালের কেমন সংস্কার প্রয়োজন, তার জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে ১৭০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছি। এ ছাড়া পাউবো খাল পুনঃখননে একটি উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণ আমাদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত দ্রুত রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন হবে, ততই এই নগরের জন্য ভালো হবে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এবিএস