‘কাঠের লাঙ্গল ও চাকা তৈরির কাজ আমার পাঁচ পুরুষের পেশা। দাদা-বাবা চলে যাওয়ার পর আমিই আগলে রেখেছি এই পেশাকে। আগলে রাখার পরেও আজ বিলিনের পথে বাপ-দাদার পেশা। দাদার পরে বাবা হাল ধরে, এরপর আমি। তবে আমার পরে কেউ ধরতে চায় না এই হাল। ছেলেরা লাঙ্গল ও চাকা তৈরির কাজ করতে চায না। আমি গত হলেই শেষ হবে পাঁচ পুরুষের লাঙ্গল ও চাকা তৈরির পেশা।’

এভাবেই ঢাকা পোস্টকে কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহী পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর হাটের মিস্ত্রিপাড়ার শ্রী তপন চন্দ্র শর্মা (৫৫)। একমাত্র তপন চন্দ্র শর্মা বিলুপ্ত প্রায় গরু-মহিষ দিয়ে কৃষি কাজের উপকরণ লাঙ্গল ও চাকা তৈরির কাজ করেন। তপনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায, নিজ বাড়ির গলিতে ধূসর রঙের শার্ট গায়ে বেশ মনোযোগ দিয়েই হাতুর-বাটাল দিয়ে ঠুক ঠুক করে কাজ করছেন তিনি। তপন জানালেন, লাঙ্গল তৈরির মূল কাজ শেষ করেছি। শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে।

পাঁচ পুরুষের পেশাকে ধরে রাখা নিয়ে হতাশ কণ্ঠে শ্রী তপন চন্দ্র শর্মা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই বানেশ্বর হাটে আমাদের পাঁচটি কারখানা ছিল। যেখানে সকাল থেকে রাতভর চলতো গরু-মহিষের লাঙ্গল ও গাড়ির চাকা তৈরির কাজ। তখন এই কাজের খুব কদর ছিল। কারখানাগুলোতে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ জন মিস্ত্রী ও শ্রমিক কাজ করতেন। অর্ডার আর ডেলিভেরি দিতে বাবা-দাদের হিমশিম খেতে হতো। কৃষি কাজে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহারের পরে হারিয়ে যেতে বসেছে লাঙ্গল ও গরুর গাড়ি। চাহিদা কম হওয়ায় বছর দশেক আগেই গরুর গাড়ির চাকা তৈরি বন্ধ করে দেই। তবে এখনো ধরে রেখেছি লাঙ্গল তৈরির কাজ। আগে দিনে একটা লাঙ্গল তৈরি করতাম। বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন আর পারি না। এখন সবই স্মৃতি হয়ে মনে পড়ে। কাজের জৌলুসের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে কারখাো, মিস্ত্রী ও শ্রমিক। তারা এখন ভিন্ন পেশার মানুষ। শুধু আমি থেকে গেলাম দাদা-বাবার পেশায়। চেয়েছিলাম ছেলে আমার পেশাকে ধরে রাখবে। কিন্তু এই পেশার প্রতি তার আগ্রহ নেই।

তপন চন্দ্র শর্মা বলেন, আমার ঠাকুর দাদা ছিলেন রসিক চন্দ্র শর্মা। আর বাবা ছিলেন ধিরেস চন্দ্র শর্মা। আমি ১০ বছর বয়স থেকে বাবার সঙ্গে কাজ শুরু করি। কাজ করতে করতেই শিখেছি। বর্তমানে দাদা-বাবা সবাই চলে গেছে। অন্য ভাইয়েরা এই কাজ করতো। তারাও আর করে না, চাহিদা না থাকায়। আমি এখনো এই পেশায় আছি। যদিও আগের মতো লাঙ্গল তৈরি অর্ডার নেই। কম সংখ্যক লাঙ্গল তৈরির অর্ডার আসে। যারা ডাকে তাদের কাজগুলো করি। রাজশাহী জেলার এমন কোনো গ্রাম নেই যে আমি কাজ করিনি। এক সময় বেশির ভাগ মানুষের লাঙ্গল আমার হাতের তৈরি হতো। রাজশাহী শহর হলেও এখনো অনেকেই আমার থেকে লাঙ্গল তৈরি করে নিয়ে যায়। অনেকের বাড়িতে গিয়ে লাঙ্গল তৈরি করে দিয়েছি, এখনো যাই। তবে বেশির ভাগ লাঙ্গল বাড়িতে তৈরি করি। অনেকেই ছাড়ে না, তখন তাদের সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে গরু বা মহিষ দেখে লাঙ্গল তৈরি করে দেই। যাতে করে জমি চাষ করা ভাল হয়। আমিও গরু-মহিষ দেখে তাদের মন মতো করে লাঙ্গল তৈরি করে দেই।

তিনি বলেন, দাদা-বাবার এই কাজকে আমি ধরে রেখেছি। যতদিন বাঁচবো এই কাজ করে যাব। এই কাজটা আমাকে ভালো লাগে। আমার বাবা (ধিরেস চন্দ্র শর্মা) ৫০ বছরের বেশি সময় এই কাজ করেছেন। আগে লাঙ্গল তৈরি ছাড়াও কাঠের চাকা তৈরি করতাম। বর্তমানে আমার কাজের বয়স ৩৮ বছর। এক সময় বানেশ্বর হাটে আমাদের কারখানা ছিল। সেখানে গরু-মহিষের লাঙ্গল ও চাকা তৈরি করে সেই চাকা গ্রামের বিভিন্ন মেলা ও হাটে বিক্রি হতো। অনেক সময় ট্রেনে করে দিনাজপুর, খুলনা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হতো বিক্রির জন্য। তখন বেশি এসবের প্রচুর চাহিদা ছিল। বর্তমানে গরুর গাড়ি প্রায় বিলুপ্ত। তার পরেও আছে কিছু। যা খুবই কম। সেই গাড়ির চাকা তৈরি করে পেটের ভাত হবে না। তাই বন্ধ করে দিয়েছি চাকা তৈরির কাজ। এখন শুধু লাঙ্গল তৈরি করি। দাদা-বাবার এই কাজটা আমি ধরে রেখেছি। এই কাজটা এখনও চলে মোটামোটি। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন লাঙ্গল তৈরির জন্য। এখান থেকে যা আয় হয় তাতে কোনো রকম ডালভাত হয়।

তপন চন্দ্র শর্মা বলেন, আমার দাদাকে আমি দেখিনি। দাদা ৭৫ বছর বেঁচে ছিলেন। বাবাকে বলতে শুনেছি এই পেশা আমার বংশপরম্পরায় চলে আসছে। এটা আমার বংশগত পেশা। গ্রাম থেকে আমি রাজশাহী শহরে গিয়ে অনেক কাজ করেছি। রাজশাহী নগরীর ভদ্রা, মেহেরচন্ডী, বুধপাড়া, নওহাটা, লালবাগান, কুখুন্ডি, হরিয়ান, দুর্গাপুর, বাগমারা, বাঘা ও চারঘাটের লোকজনের লাঙ্গল তৈরি করে দিয়েছি। তারাও আমাদের এখানে আসে। আমার যতোটা মনে পরে, সবমিলে প্রায় ২০০ গ্রামে কাজ করেছি। ৩৭ থেকে ৩৮ বছর আগের যেসব কাস্টমার ছিল লাঙ্গল তৈরির, তাদের নাম ও মূল্য আমার খাতায় এখনো লেখা আছে। জীবনে আমি যত জনের কাজ করেছি তাদের সবার নাম পরিচয় লেখা আছে খাতায়। এমনকি সেই সময় আমি কত টাকা মজুরিতে কাজ করেছি সেটিও লেখা আছে খাতায়।

গরুর গাড়ির চাকা তৈরির বিষয়ে তপন চন্দ্র শর্মা বলেন, গরুর গাড়ির চাকা তৈরি করতে ৩১ টুকরা কাঠ লাগে। এই ৩১ টুকরা কাঠ দিয়ে একটি চাকা তৈরি করা হয়। তবে মজার বিষয় এই চাকা তৈরিতে কোনো লোহার কাঁটা ব্যবহার করা হয় না। কাঠ দিয়ে চাকা তৈরির কাঠ আটা হয় কাঠ দিয়েই। তার উপরে ৫০ থেকে ৬০ মণ মাল বহন করা যায়। অথচ কোনো নড়াচড়া বা শব্দ হয় না। দাদা রসিক চন্দ্র শর্মার থেকে শুনে বাবা বলেছিলেন, ব্রিটিশ সরকারের লোক এসেছিলেন নাটোরের লালপুরের গৌরিপুরে। তিনি দাদা হাতের তৈরি কাঠের চাকা দেখে প্রশংসা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এদের এতো বুদ্ধি। কোনো লোহা-লক্কর, নাট-বোল্টু না ব্যবহার করে কাঠের চাকা তৈরি করেছে।

তিনি আরও বলেন, একটি চাকায় ব্যবহার করা ৩১ টুকরা কাঠের নাম আছে। যেমন আঁরা, সাহারা, গজ, নিমারা, লাহা, পুঠি, চুল (কাঠের), পচরা। লাঙ্গল তৈরিতে আমরা বাবলা কাঠ ব্যবহার করি। এটি অনেক শক্ত কাঠ। সহজে ভাঙ্গে না। আর ক্ষয় কম হয়। লাঙ্গল পুরোপুরি সম্পন্ন করতে লাঙ্গলের সঙ্গে ফলক লাগানো হয়। তার নাম ফাল। ফালকে ধরে রাখার জন্য যে জিনিসটি ব্যবহার হয় সেটি পাশি। লাঙ্গলের মাঝে লাগানো হয় ঈষ। আর ঈষ আটার জন্য থাকে দিস্তি। আর পুরো লাঙ্গল ভালোভাবে ধরার জন্য ব্যবহার হয় লিজিন।

তিনি বলেন, আমি দেখেছি আমার বাবা ধিরেস চন্দ্র শর্মাকে ৫ টাকা মজুরিতে লাঙ্গল বানাতে। তখন আমার বয়স ১৩ থেকে ১৪ বছর। তখন থেকেই বাবার সঙ্গে কাজ শুরু করি। আমি লাঙ্গল বাধা (তৈরি করা) শিখার পরে কাজ শুরু করি।  যতদূর মনে হয় ৫০ টাকা মুজরি দিয়ে শুরু হয় আমার কাজ। এখন এর মজুরি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা। আর কাঠসহ সবকিছু দিয়ে তৈরি করা লাঙ্গল বিক্রি করি ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকায়। আগে বাবলা কাঠ সব জায়গায় পাওয়া যেত। কিন্তু এখন পতিত জমি কমে যাওয়ার কারণে বাবলা গাছ তেমন নেই। তাই বাবলা কাঠের সঙ্কট রয়েছে। বেশি দামে বাবলা কাঠ কিনতে হয়। এতে করে লঙ্গল তৈরির খরচ বেড়ে যায়।

লাঙ্গল দিয়ে কৃষি জমি চাষ করেন বাদল হোসেন। তিনি রাজশাহী নগরীর বুধপাড়া এলাকার বাসিন্দা। বাদলও লাঙ্গল তৈরি করে আনেন পুঠিয়ার তপনের কাছ থেকে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, তপনের বাবার থেকে আগে লাঙ্গল তৈরি করে নিতাম। তার বাবা ধিরেস লাঙ্গল বানাতো। ধিরেস মারা যাওয়ার পরে এখন তার ছেলে তপন লাঙ্গল বানায়।

দীর্ঘদিন লাঙ্গল ও মহিষের গাড়ি নিয়ে কাজ করেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন (৬৫)। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আগে তো গরু ও মহিষের লাঙ্গল ছাড়া জমি চাষের বিকল্প কিছু ছিল না। আমার বাড়িতে একটা মহিষের গাড়ি ও দুই জোরা লাঙ্গল ছিল। এখনো খুঁজলে কিছু না কিছু পাওয়া যাবে। এখনো জমি চাষের ট্রাক্ট্রর আসায় মানুষ আর লাঙ্গল ডাকে না। তবে জমি ভালো চাষের জন্য এখনও লাঙ্গলের বিকল্প নেই।  আমাদের গ্রাম এলাকা সমাজ ভিত্তিক। আমাদের সমাজে ৫০ ঘর হলে তার মধ্যে ৬ ঘরের মানুষের লাঙ্গল ছিল। এখন পুরো সমাজজুড়ে একজনেরও নেই। তিন থেকে চার গ্রাম পর পর একজনের লাঙ্গল গরু আছে। তাও তিনি জমি চাষের সিরিয়াল দিতে পারেন না।

পুঠিয়ার বানেশ্বর হাট ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার মো. আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, তাদের (তপনের দাদা, বাবা) হাতের কাজ অনেক সুন্দর ও ভালো। তাই দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ তাদের কাছে কাজ করাতে আসতেন। তারা কাঠ দিয়ে গরু-মহিষের লাঙ্গল ও গাড়ির চাকা তৈরি করেছেন দীর্ঘ দিন। অধুনিক যুগ ও কৃষি কাজে আধুনিকতার ছোয়ায় লাঙ্গল ও গরু, মহিষের গাড়ির আর কাজ নেই। তাই তাদেরও কাজের চাহিদা নেই।

পুঠিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার স্মৃতি রানী সরকার ঢাকা পোস্ট বলেন, এখন শ্রমিক সংঙ্কট লক্ষ্য করা যায়। কৃষিতে যন্ত্রপাতির ব্যবহার জরুরি। আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারের ফলে উৎপাদন ও খরচ দুই কমেছে। তবে এখনো লাঙ্গলের ব্যবহার আছে। তবে অনেক কম। তার (তপন চন্দ্র শর্মা) এই কাজে না চললে তাকে পেশা পরিবর্তন করতে হবে।

শাহিনুল আশিক/এবিএস