রাজবাড়ীতে প্রায় ২০টি অনুমোদনহীন কারখানায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিম্নমানের কেমিক্যাল, কাপড়ের রং, স্যাকারিন ও কৃত্রিম সুগন্ধি মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে আইসক্রিম। এসব আইসক্রিম খেয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ।

সরেজমিনে রাজবাড়ী সদর উপজেলার পাবলিক হেলথ এলাকার ডিম্পল আইসক্রিম ফ্যাক্টরি, বালিয়াকান্দির রামদিয়া বাজারের প্রাণ সুপার আইসক্রিম, সোনাপুর বাজারের নাম্বার ওয়াম আইসক্রিম, পাংশার পিপাসা আইসক্রিম ও বস আইসক্রিম কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, অত্যন্ত স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে নোংরা পানি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে আইসক্রিম। আকর্ষণীয় করতে মেশানো হচ্ছে কাপড়ের রং। চিনির পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষতিকর ঘন চিনি, স্যাকারিন, আম ও লিচুর স্বাদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষতিকারক ফ্লেভার এবং গরুর দুধের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে ভেজাল গুঁড়াদুধ, ফ্যান। অপরিচ্ছন্ন বালতিতে খালি হাতেই মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকারক সব উপকরণ। বেশিরভাগ কারখানার শ্রমিকদের হাতে গ্লাভস, মাথায় টুপি, গায়ে অ্যাপ্রোন ছিল না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইসক্রিম তৈরি করতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)-এর অনুমোদনের প্রয়োজন হলেও এই জেলার একটি আইসক্রিম কারখানারও সেই অনুমোদন নেই।

অস্বাস্থ্যকর এসব আইসক্রিম বাহারি সব মোড়কে সরবরাহ করা হচ্ছে জেলার বিভিন্ন দোকানে। তীব্র দাবদাহে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য শিশুদের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষও এই আইসক্রিম মুখে দেয়। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে তারা।

এদিকে, অনুমোদন না থাকা এবং আইসক্রিমে অস্বাস্থ্যকর উপাদান ব্যবহারের কথা স্বীকার করেছেন কারখানার মালিক ও শ্রমিকরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজবাড়ীর পাবলিক হেলথ এলাকার ডিম্পল আইসক্রিম ফ্যাক্টরির একজন শ্রমিক বলেন, আইসক্রিমে আম, লিচু ও দই এর স্বাদ আনার জন বিভিন্ন ক্ষতিকারক ফ্লেভার ব্যবহার করা হয়। এছারাও আইসক্রিমে বিভিন্ন বাহারি রং আনার জন্য বিভিন্ন কেমিক্যাল ও রং ব্যবহার করা হয়। এসব ব্যবহার না করলে আইসক্রিম দেখতে আকর্ষণীয় হয় না, তখন মানুষ খেতেও চায় না।

সোনারপুর বাজারের নাম্বার ওয়ান আইসক্রিম কারখানার মালিক বলেন, রং ও কৃত্রিম ফ্লেভার ছাড়া আইসক্রিম হয় না। ক্ষতিকারক জেনেও আমরা তৈরি করছি।

বিএসটিআই এর অনুমোদন আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এবার নতুন কারখানা দিয়েছি। তাই আমাদের কোনে অনুমোদন নেই।

পাংশার বস আইসক্রিম কারখানার মালিক বলেন, আইসক্রিম কিছুটা আকর্ষণীয় করতে দুধের সঙ্গে অল্প পরিমাণ রং দেওয়া হয়। এতে কোনো ক্ষতি নেই।

পিপাসা আইসক্রিম কারখানার কারিগর সুজন দাবি করেন, আইসক্রিম তৈরি করতে স্যাকারিন ব্যবহার করতেই হয়। স্যাকারিন ছাড়া আইসক্রিম তৈরি হয় না। তাই স্যাকারিন ব্যবহার করি। তবে স্যাকারিনের সঙ্গে চিনিও ব্যবহার করা হয়।

অস্বাস্থ্যকর এসব আইসক্রিমের ব্যাপারে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ রাজবাড়ী জেলা কার্যালয়ের নিরাপদ খাদ্য অফিসার রফিকুল ইসলাম বলেন, আইসক্রিম কারখানাগুলোতে অনেক সময় চিনির পরিবর্তে ঘনচিনি বা সোডিয়াম সাইক্লোমেট ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ঘনচিনি খাওয়ার ফলে মানুষের দৃষ্টিহীনতা ও নিদ্রাহীনতা দেখা দেয়, বমিবমি ভাব হয়, মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়। এছাড়া অনেক সময় তারা আইসক্রিমে অনুমোদনহীন রং ব্যবহার করে থাকে। এই রং মানুষের লিভার সিরোসিস ও কিডনী ডিজিজের জন্য দায়ী। এছাড়া দীর্ঘ সময় এ রং খেলে ক্যান্সার হয়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, রাজবাড়ীর আইসক্রিম কারখানার মালিকদের নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের আইসক্রিমে ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার না করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিএসটিআই ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের সনদপত্র সংগ্রহ করে যথাযথ নিয়ম মেনে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য বলা হয়েছে। কোনো অসাধু ব্যবসায়ী এ নির্দেশনা না মানলে তার বিরুদ্ধে আমরা নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।

মীর সামসুজ্জামান/এবিএস