‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানি, দেব খোঁপায় তারার ফুল/কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির/ চৈতি চাঁদের দুল/ কণ্ঠে তোমার পরাব বালিকা/ হংস-সারির দুলানো মালিকা/ বিজলি-জরিন ফিতায় বাঁধিব/মেঘ-রং এলো চুল।’ যুগ যুগ ধরে বাঙালি সমাজে নিগ্রহের শিকার নারীদের নিয়ে কবি নজরুলের পঙ্কতিগুলো নারীদের জয়গানকে নির্দেশ করে। 

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২০ সালে শুনিয়েছিলেন- ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ এমন তেজদ্বীপ্ত প্রাণস্পর্শী বাণীতে অন্য কেউ কখনো বঙ্গ ললনার অধিকার ঘোষণা করেননি। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে বীরাঙ্গনা নারীর মহিমা ও আদর্শ তুলে ধরেও নারী জাগরণের মন্ত্রণা দিয়েছেন কবি নজরুল। 

কবি তার কবিতায় বলেছেন- ‘অসতী মাতার পুত্র সে যদি তবে, জারজ পুত্র হয়। অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়।’ কবি নজরুলের এই ‘বারাঙ্গনা’ কবিতা যেন এক বিপ্লব। সেই সময়ে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কবির এমন সাহসী উচ্চারণ, যা নারীর ভেতরের শক্তিকে উন্মোচিত করেছিল।

নজরুল তার রচনায় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে মোগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, মমতাজ, চাঁদ সুলতানা, ইরানি বালিকা, রাধাসহ বিভিন্ন চরিত্রকে যেমন সুন্দর করে তুলে ধরেছেন, তেমনি সমান মর্যাদায় রাজদাসী আনারকলিকেও উপস্থাপন করেছেন। আবার অপূর্ব বিদ্রোহী চেতনায় সৃষ্টি করেছেন মেজো বউয়ের মতো এক দীপ্ত চেতনার নারীকে। 

‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা/জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত টিকা/দিকে দিকে ফেলি তব লেলিহান রসনা/নেচে চল উন্মাদিনী নিরবসনা/জাগো হতভাগিনী, ধর্ষিতা নাগিনী। জাগো বধূ জাগো নব বাসরে/গৃহদীপ জ্বালো কল্যাণ করে।’ এমন অতুলনীয় ভাষায় নারী শক্তির জাগরণ কামনা করছেন কবি। নারীর অধিকার ও মর্যাদার আবেশ ফুটে উঠেছে নজরুলের এসব লেখায়। পাশাপাশি পত্রিকার পাতায় ও রেডিওতে নিয়েছিলেন বিভিন্ন উদ্যোগ। 

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. জাহিদুল কবীর বলেন, একজন কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম এটি অনুধাবন করেছিলেন যে, মানুষের অর্ধেক জনসমষ্টিকে বাইরে রেখে কখনো উন্নতি সাধন সম্ভব নয়। সাহিত্যের মাধ্যমে, সংগীতের মাধ্যমে, সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে নারীকে প্রাধান্য দিয়ে নারীকে মূলধারায় আনার যে চেষ্টা তিনি করেছিলেন সেটা নতুন আলোর একটা নির্দেশনা ছিল। নজরুল তার সৃষ্টিতে এটি করে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। তিনি নারীকে সামনে আনার জন্য মনেপ্রাণে চেষ্টা করেছেন। 

গবেষকেরা বলছেন, নজরুলের যে আদর্শ, মানবতার জয়গান গেয়েছিলেন, শ্রেণিহীন বৈষম্যহীন যে সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা বাস্তবায়নে নজরুল চর্চার বিকল্প নেই। নারী জাগরণের যে বাণী নজরুল দিয়েছিলেন, যে উদার ও আধুকিতাকে ধারণ করেছিলেন, তা মনের গভীরে রোপণ করতে হবে।

নজরুল গবেষক ড. দেবাশীষ বেপারী বলেন, কবি নজরুল কলকাতা বেতার কেন্দ্রে যখন কাজ করতেন তখন ‘পঞ্চাঙ্গনা’ নামে একটি গীতি আলেক্ষ শুধু নারীদের কেন্দ্র করেই একটি অনুষ্ঠান প্রচার করেছিলেন। যেটার গ্রন্থনা, গান রচনা, সুর প্রয়োগসহ সবই কাজী নজরুল করেছিলেন। সেই সময় উপমহাদেশের বিখ্যাতদের মধ্যে যেসব প্রতিভাবান বা কীর্তিমান নারী ছিলেন তাদেরকে নিয়ে গান রচনা করেছিলেন। কারণ তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে নারীদের আরও সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া দরকার। তার গানে-কবিতায় সর্বত্রই নারীদের জয়জয়কার দেখতে পাই। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতাটা কিছুটা ম্লান হয়েছে। এই যুগেও যদি আমরা সেই ধারা অব্যাহত রাখতে পারতাম তাহলে আমাদের নারী জাগরণ, নারীর অনগ্রসরতা আরও বেশি ফলপ্রসূ হতো আমাদের সমাজে। 

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ইন্দ্রানী কর্মকার মনে করেন, বর্তমানে যারা নারী আন্দোলন নিয়ে কাজ করছেন, নারীদের জাগরণে কাজ করছেন তাদের উচিত নজরুলের যেসব সৃষ্টিকর্ম আছে সেগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং সেই আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। সাধারণ মানুষের মাঝে সেই বাণীগুলো পৌঁছে দিতে হবে। কীভাবে কাজ করলে পরে নারীদের অগ্রগতি সম্ভব হবে সেটা নজরুল থেকেই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে এবং ছড়িয়ে দিতে হবে। 

নজরুলের নারী জাগরণের চেতনা প্রসঙ্গে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, কবি নজরুলের যে নারী জাগরণের চেতনা সেটি উপনিবেশিক ভারতের বুকে দাঁড়িয়ে নারীদের স্বাধিকার আন্দোলনে যুক্ত হতে বলেছেন এবং আত্মমুক্তির কথা তিনি বলেছেন। নারীদের সম্পর্কে নজরুলের বক্তব্য হচ্ছে- নারীদের দরজা দুদিক থেকে বন্ধ। একটি বাইরে থেকে বন্ধ আবার ওই দরজায় নারীরা ভেতর থেকে বন্ধ করে রেখেছে। অর্থাৎ প্রথমে নারীদের আত্মজাগরণ করতে হবে। তারপর বাইরে থেকে এই দরজা খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। 

তিনি বলেন, নজরুলের ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা/জাগো স্বাহা...’ এই যে ‘স্বাহা’ শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছেন এই ‘স্বাহা’ হচ্ছে অগ্নির স্ত্রীবাচক। এটির মধ্য দিয়ে নারীকে তিনি আগুনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যে আগুন সভ্যতার প্রতীক এবং যে আগুন দিয়ে মূলত আজকের যে অগ্রগতি সেটিরও প্রতীক হিসেবে আমরা মনে করে থাকি। নারী জাগরণের এই যে চেতনা নজরুল তার সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে দেখিয়েছেন, একইসঙ্গে এই চেতনাকে তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নারীদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি প্রভৃতিতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। নজরুলের সাহিত্যে যে নারী জাগরণের কথা উঠে আসে সেটি নারীর আত্মমুক্তি এবং বহিঃজগতে মুক্তির নিশানা দেয়। 

নারী মুক্তি ছিল কবি নজরুলের স্বপ্ন ও সাধ। নারীর লুকায়িত শক্তিমত্তায় ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। সেজন্যই নারীত্বের জয়গানে মুখর ছিল তার কলম। নজরুল জানতেন নিষেধের বেড়াজাল আর প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে নারী জয় করবেই। তাইতো তিনি লিখে রেখে গেছেন- ‘শত নিষেধের সিন্দুর মাঝে অন্তরালের অন্তরীপ/তারি বুকে নারী বসে আছে জ্বালি বিপদ বাতির সিন্ধুদ্বীপ।’

উবায়দুল হক/আরএআর