বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহানারা বেগম টানা তিনবার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তিনি ছাত্রজীবনে কখনো রাজনীতি করেননি। তবে ২০০৩ সালে স্বামীর অনুপ্রেরণায় নির্বাচনে অংশ নেন। আরেক কাউন্সিলর প্রার্থী আয়শা তৌহিদ লুনা। তিনি টানা তৃতীয়বার কাউন্সিলর থেকে চতুর্থবার নির্বাচনে লড়ছেন। ছাত্রজীবনে তিনিও রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। তবে স্বামীর অনুপ্রেরণায় নির্বাচনে নেমে পরপর জয়ী হয়েছেন। 

শুধু জাহানারা ও আয়শা নয়, সংরক্ষিত ওয়ার্ডগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের উল্লেখযোগ‌্য সংখ‌্যকের রাজনৈতিক কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। এমনকি প্রায় দুই তৃতীয়াংশ প্রার্থীর নিজস্ব কোনো আয়ের উৎস নেই। আর ৫০ শতাংশ প্রার্থী মাধ‌্যমিকের গন্ডি পার করতে পারেননি।  

এসব প্রার্থীরা স্বামী বা পরিবারের অন‌্য কারো ওপর নির্ভরশীল। তারপরও তারা জনসেবায় নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে সবসময় কাজ করে যাচ্ছেন। আর নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণকে  ইতিবাচক দেখেছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।

আগামী ১২ জুন অনুষ্ঠিতব্য বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়া সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে

রিটার্নিং কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির জানিয়েছেন, যাছাই-বাছাই, প্রত‌্যাহার আর বাতিলের পর নির্বাচনে মোট ১৬৫ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছে। এর মধ‌্যে সংরক্ষিত ১০টি ওয়ার্ডে ৪২ জন নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মোট ৪২ প্রার্থীর মধ‌্যে ৮৬ শতাংশের মূল পেশা গৃহিণী। অনেকে লিখেছেন হাঁস-মুরগি প্রতিপালন। ৫ জন রয়েছেন ব‌্যবসায়ী আর একজন রয়েছেন একটি বেসরকারি হাসপাতালের রিসিপসনিস্ট। ফলে প্রার্থীরা উল্লেখযোগ‌্যভাবে নিজস্ব কোনো সম্পদ দেখাতে পারেননি। শিক্ষাগত যোগ‌্যতাও তেমন নেই। মোট প্রার্থীর মধ‌্যে ৫০ শতাংশ এসএসসি পাস করতে পারেননি। যে পঞ্চাশ শতাংশ এসএসসি পাস করতে পারেননি তাদের অধিকাংশ আবার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ায় সীমাবদ্ধ। আবার অনেকে এখনো উন্মুক্ত বিশ্ববিদ‌্যালয়ে পড়ালেখা করছেন। ১৬ শতাংশ প্রার্থী এসএসসি পাস করেছেন। আর ৩৩ শতাংশের কিছু বেশি প্রার্থী উচ্চ মাধ‌্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পাস করেছেন। 

নির্বাচন বিশ্লেষক বরিশাল বিশ্ববিদ‌্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম‌্যান সোহেল রানা বলেন, নারীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এটি অত‌্যন্ত  ইতিবাচক বিষয়। যাকে আমরা গৃহিণী অভিধা দিচ্ছি তিনি কিন্তু একটি ঘর, পরিবার সামলাচ্ছেন। পরিবার সামলানো কম নয়। আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির সমস‌্যা রয়েছে যে কারণে নারীকে গৃহিণী বলে তুচ্ছ করে। তাকে কিন্তু গৃহের পরিচালক বলছে না। যাকে গৃহিণী বলে নির্বাচনে আসাটাকে ভিন্ন চোখে দেখছি তিনিও কিন্তু পরিবারের কর্তার সঙ্গে পলিসি মেকার। পরিবার চালানোর ক্ষেত্রে তাকে ছোট ছোট সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেই মানুষটি যদি জনপ্রতিনিধি হন তাহলে ঘরের মতই নিজ এলাকার পলিসি মেকার হতে পারেন।

তবে শিক্ষাগত যোগ‌্যতার দিক দিয়ে আরেকটু এগিয়ে আসার প্রত‌্যাশা রেখে তিনি বলেন, এলাকার উন্নয়নে দীর্ঘ মেয়াদি নীতি গঠনে একাডেমিক শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে। তবে তার চেয়েও গুরুত্ব বেশি বহন করে জনসম্পৃক্ততা। কারণ অনেক শিক্ষিত রয়েছেন যিনি জনকল‌্যাণের জন‌্য নিজেকে যুক্ত করছেন না, তার চেয়ে যিনি কম শিক্ষিত কিন্তু মানবকল‌্যাণে কাজ করছেন, তিনিইতো গুরুত্বপূর্ণ।

সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর আয়শা তৌহিদ লুনা বলেন, আমার স্বামীর অনুপ্রেরণায় আমি এই পথে এসেছি। তিনি আমাকে বলতেন তুমি পারবে। তোমাকে জনসেবায় মানায়।

কাউন্সিলর জাহানারা বেগমও স্বীকার করেন, ছাত্রজীবনে রাজনীতি না করেও একমাত্র স্বামী ও এলাকাবাসীর চাওয়ায় নির্বাচনে অংশ নেন। 

সুশাসনের জন‌্য নাগরিক (সুজন) বরিশাল মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলমস বলেন, সরকারের ইতিবাচক উদ‌্যোগ হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়নে আসন সংরক্ষিত করে দেওয়া। প্রার্থী গৃহিণী হওয়া কোনো সমস‌্যা নয়। তবে এটাকে পরিবারের কেউ কেউ সুযোগ হিসেবে নেয়। আমরা অনেক স্থানে দেখি স্ত্রী ইউপি সদস্য অথচ সকল সিদ্ধান্ত নেন তার স্বামী। এই বিষয়টি ঠিক না।

সচেতন নাগরিক কমিটির বরিশাল জেলার সভাপতি অধ‌্যাপক গাজী আনোয়ার হোসেন বলেন, অত‌্যন্ত ইতিবাচক দিক হলো গৃহিণীরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এভাব পর্যায়ক্রমে দেশে নারীর ক্ষমতায়ন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে।

 সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর