কাউন্সিলর সাইদুর রহমান জাকির

শ্রমিক নেতা সুমন মোল্লাকে ইফতারির আগে ঘর থেকে নামিয়ে কুপিয়ে জখম করে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ২৫নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাইদুর রহমান জাকিরের নেতৃত্বে ৩০-৪০ জনের একটি দল। সেই দলে ছিলেন কাউন্সিলরের বড় ভাই মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদুর রহমান মনির, ছোট ভাই মামুন মোল্লাও। 

এমনকি কোনো হাসপাতালেও যেন না নেওয়া হয় সেই হুমকি দিয়ে আসেন কাউন্সিলর। গুরুতর আহত হওয়ায় শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন সুমন। তবে জাহিদুর রহমান মনিরের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেতাদের হামলায় আহত সাবেক কাউন্সিলর সুলতান মাহমুদ কোনো হাসপাতালে চিকিৎসাও নিতে পারেননি।
 
অভিযোগ রয়েছে রুপাতলী এলাকার আধিপত‌্য ধরে রাখতে এভাবে নির্যাতন-হয়রানি চালাতেন দাপটশালী এই কাউন্সিলর। মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারী হওয়ায় তাদের নির্যাতনের শিকার হয়েও মুখ খুলতে সাহস করতেন না কেউ। 

তবে সাদিক আব্দুল্লাহ আসন্ন সিটি নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়ায় এই কাউন্সিলরের বিষয়ে কথা বলছেন ওয়ার্ডবাসী। তারা বলছেন, আধিপত‌্য ধরে রাখতে গিয়ে ওয়ার্ডের উন্নয়নে হাত দেওয়ার সময় পাননি। তবে পুনরায় নির্বাচিত হলে জনসেবায় নিজেকে ব‌্যস্ত রাখবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন জাকির।

বরিশাল শহরের প্রবেশদ্বারখ‌্যাত রুপাতলী বাস টার্মিনাল, পল্লী বিদ‌্যুৎ ও ওজোপাডিকোর বিভাগীয় কার্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ‌্যালয় শাখা, সামিট পাওয়ার, একটি বাজার, চারটি হাউজিং, পিবিআই, সিআইডি, র‌্যাব সদর দপ্তরসহ জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে সিটি করপোরেশনের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে।

ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, দুটি সড়ক বাদে অন‌্য সকল সড়ক খানাখন্দে ভরা। এর মধ‌্যে মওলানা ভাসানী সড়ক থেকে ফকির বাড়ি, আহম্মেদ মোল্লা সড়ক, বটতলা হাইস্কুল থেকে কীর্তনখোলার পাড়, সামটির পাওয়ারের সামনে থেকে কীর্তনখোলা নদীর পাড়, আদর্শ সড়ক থেকে কাজী বাড়ি, মৃধা বাড়ি থেকে মিস্ত্রি বাড়ি- এই সড়কগুলো চলাচলের সম্পূর্ণ অনুপযোগী। একটু বর্ষা এলেই হাঁটু সমান পানিতে ডুবে যায় এসব সড়ক। বর্ষা ছাড়াও সড়কে জমে থাকা পানিতে হাঁস সাঁতার কাটতে দেখা গেছে।

ওয়ার্ডের ভোটার ভাসানী সড়ক এলাকার বাসিন্দা নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, মানুষকে মারধর, নির্যাতন চালাতেই ব‌্যস্ত থাকায় উন্নয়নের সময় পাননি কাউন্সিলর সাইদুর রহমান জাকির। বরং সামর্থের বাইরে ট‌্যাক্স বাড়িয়েছেন। প্রতিটি ঘরে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার ট‌্যাক্স বাড়িয়ে দিয়েছেন। যে ঘরে আগে ট‌্যাক্স দিত হতো ৭ হাজার টাকা সেই ঘরে ট‌্যাক্স করেছে ২৫ হাজার টাকা। ওয়ার্ডের মধ‌্যে যে কয়টি ডেইরি ফার্ম রয়েছে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন দপ্তরের কথা বলে ভয়ভীতি দেখিয়ে ৪-৫ লাখ টাকা চাঁদা হিসেবে নিয়েছেন। পাঁচ বছরে কাউন্সিলরের কাছ থেকে কোনো উপকার হয়নি।

ফকির বাড়ি সড়কের বাসিন্দা আব্দুর রব বলেন, বর্ষা এলেই ফকির বাড়ি থেকে রুপাতলী যেতে আমাদের নৌকায় চলাচল করতে হয়। হেঁটে বা গাড়িতে চলাচলের কোনো সুযোগ থাকে না। 

গ‌্যাসটারবাইন এলাকার বাসিন্দা শাহিন বলেন, অটো গাড়ি চালিয়ে দিনে যে কয় টাকা আয় করি তা আবার গাড়ি মেরামত করতেই চলে যায়। রুপাতলী থেকে দপদপিয়া ফেরিঘাট, গ‌্যাসটারবাইন, সামিট পাওয়ার, আদর্শ সড়ক কোথাও একটি সড়ক ভালো নেই। ভোটের সময় এলে কাউন্সিলর আসেন। এরপর আর তাকে খুঁজেও পাওয়া যায় না।

একটি সরকারি ব‌্যাংকের কর্মকর্তা জানান, কাউন্সিলরের বিষয়ে কথা বললে দেখবো আমার দালানের ট‌্যাক্স আকাশচুম্বি হয়ে গেছে। তিনি নির্বাচিত হয়ে জনসেবায় ছিলেন না। আধিপত‌্য ধরে রাখতে নানা অপকর্ম করেছেন।

আদর্শ সড়কের বাসিন্দা তৌহিদুর রহমান বলেন, কাউন্সিলর এলাকায় ক‌্যাম্পেইন করছেন। তিনি সকলের কাছে এখন মাফ চাইছেন, যেন আরেকবার সুযোগ দেওয়া হয়। আমাদের বাসায়ও এসেছিলেন।

শ্রমিক নেতা রফিকুল ইসলাম মানিক বলেন, সাদিক আব্দুল্লাহর নির্দেশে আমাদের ওপর হামলার সিসি ক‌্যামেরার ফুটেজে দেখেছি- হামলাকারীদের সঙ্গে এসে ভবনের নিচেই অপেক্ষা করছিলেন জাহিদুর রহমান মনির, কাউন্সিলর জাকির। সাজ্জাদ, মুনিম, মান্না, রাজীবের নেতৃত্বে আমাদের মারধর করার পর ভয়ে কোনো হাসপাতালে চিকিৎসাও নিতে পারিনি। 

জেলা বাস-মিনিবাস কোচ-মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান সুমন জানান, ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে বাসায় ঢুকে আমাকে কুপিয়ে জখম করা হয়। আমাকে কোপানোর নেতৃত্ব দেন বর্তমান ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইদুর রহমান জাকির, তার ভাই জাহিদুর রহমান মনির। তাদের ছোট ভাই ছাত্রদল নেতা মামুন মোল্লা, ২৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী সাফিন মাহমুদ তারিক, ২৫ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান মাসুমসহ ৩০/৩৫ জন। মামলাটি এখন তদন্ত চলছে। মূলত সাদিক আব্দুল্লাহ পুলিশকে বলে তদন্ত থামিয়ে রেখেছিল।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত কাউন্সিলর সাইদুর রহমান জাকির। তিনি বলেন, আমি কী জন‌্য উন্নয়ন করতে পারিনি তা বরিশালবাসী সকলেই জানেন। এটার আর বক্তব‌্যের কিছু নেই। তবে আবার নির্বাচিত হতে পারলে সড়কগুলোর সংস্কার করবো। এসব সড়ক মেরামতের টেন্ডার হয়ে আছে।

শ্রমিক নেতাকে হত‌্যাচেষ্টার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তখন একটি গ্রুপিংয়ের কারণে ওই মামলায় আমাকে জড়ানো হয়েছে। রুপাতলী বাস টার্মিনালে একটি ঝামেলা চলছিল। তাছাড়া এলাকার কাউন্সিলর হিসেবে ওখানে আমার যাওয়া লাগে সেজন‌্য গিয়েছিলাম। কুপিয়ে জখমের ঘটনার সময় উপস্থিত থাকলেও এর সঙ্গে তিনি জড়িত নন বলে দাবি করেন।  

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর