সাতক্ষীরার কলারোয়ায় ইউরোপে রপ্তানি হওয়া টালি শিল্পে ধস নেমেছে। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে ৪১টি কারখানার মধ্য বন্ধ হয়েছে অর্ধেকেরও বেশি। ২৯টি কারখানা বন্ধ হয়ে এখন নাম মাত্র চলছে ১২টি কারখানা। কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষতিতে পড়েছে সংশ্লিষ্ট মালিক ও শ্রমিকরা। 

প্রথম ২০০২ সালে ইতালিতে রপ্তানি শুরু হয় সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা সদরের মুরারিকাটিতে তৈরি মাটির টালি। ইতালিতে বাংলাদেশে তৈরি এই টালির জনপ্রিয়তা পাওয়ায় ধীরে ধীরে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশে রপ্তানি শুরু হয়। সে সময়ে প্রায় ২৫-৩০ কোটি টাকার টালি রপ্তানি হতো প্রতি বছর।

তবে ধীরে ধীরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ অন্যান্য নানাবিধ সংকটের প্রভাবে টালি শিল্পে ধস নামতে শুরু করে। ২০১৪ সালের দিকে ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে টালির চাহিদা কমে যায় এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারখানা মালিকরা। সে সময় বাধ্য হয়ে অসাধু বিশেষজ্ঞদের খপ্পরে পড়ে কয়েক কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারখানা মালিকরা। পরবর্তীতে সে টাকা উদ্ধার করতে পারেনি কেউ। এরপর ধীরে ধীরে কারখানাগুলো বন্ধ হতে থাকে। তবে এখন চালু থাকা ১২টি কারখানা থেকে বছরে প্রায় ১২-১৫ কোটি টাকার টালি বিদেশের রপ্তানি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান মালিকদের দাবি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও অন্যান্য সুবিধা না পেলে অচিরেই বিলুপ্তি হয়ে যাবে টালি শিল্প। এতে দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন প্রতিষ্ঠান মালিকরা। 

নৃত্য নাথ নামে এক শ্রমিক বলেন, বছরের অর্ধেক সময় মৃৎশিল্পের কাজ হয়। বৃষ্টির সময়সহ বেশ কয়েক মাস কাজ বন্ধ থাকে। মাত্র ৩০০ টাকা মজুরিতে সারাদিন শ্রম দিতে হয়। বংশপরম্পরায় রেখে যাওয়া পেশা পরিবর্তন করতে পারি না বলে লোকসান হলেও এ কাজ করে যেতে হয়। প্রথমদিকে আশপাশে অনেক কারখানা ছিল সেখানে অনেক শ্রমিক কাজ করতো। সেই সময়টাতে ব্যবসায়ী, শ্রমিক সহকারখানা মালিকরা বেশ লাভজনকভাবে ব্যবসা করেছে। কিন্তু এই ব্যবসায় এখন লোকসানের মুখে। 

কলারোয়ার মুরারিকাটি পালপাড়ার দীপা টালি কারখানার মালিক বাদল চন্দ্র পাল বলেন, শুরুর দিকে এখানকার তৈরি টালি বেশ লাভজনকভাবে ইতালিতে রপ্তানি হতো। তবে প্রতিষ্ঠান মালিকদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অর্থনৈতিক মান্দার প্রভাবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রয়েছে সেগুলোও নাম মাত্র চলে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ অন্যান্য সুবিধা পেলে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব অন্যথায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে বিশ্বখ্যাত এই টালিশিল্প। 

তিনি আরও জানান, শ্রমিকের মূল্য বৃদ্ধি অপরদিকে মাটি, কয়লাসহ অন্যান্য সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু টালির মূল্য প্রথমে ছয় টাকা ছিল পরবর্তীতে সেই মূল্যের খুব বেশি কোনো পরিবর্তন হয়নি। 

কলারোয়ার টালি কারখানা মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি গোষ্ঠবিহারী পাল জানান, এখানকার টালির খ্যাতি রয়েছে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে। এক সময় সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করা গেলেও এখন নানাবিধ সংকটের কারণে এই শিল্প বন্ধ হওয়ার উপক্রম রয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ অন্যান্য সুবিধা না পেলে বিলুপ্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এই শিল্পের। কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৩০টির বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়া কারখানার সঙ্গে জড়িত কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা ও  অভ্যন্তরীণ সমস্যাসহ নানাবিধ কারণে এই শিল্পে ধস নেমেছে। শুরুর দিকে এখান থেকে বছরে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার টালি রপ্তানি করা হতো। প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন রপ্তানি মূল্য এসে দাঁড়িয়েছে ১২ থেকে ১৫ কোটিতে। আবার কাঠ-কয়লা-মাটিসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়লেও বাড়েনি টালির দাম। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হস্তক্ষেপে পূর্বের অবস্থানে ফিরে যাওয়া সম্ভব বলে জানান তিনি।

কলারোয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু বলেন, শুরুর দিকে এখান থেকে বিদেশে টালি রপ্তানি করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লাভবান হয়েছে কারখানা মালিকরা। এ সব কারখানায় সে সময়ে প্রায় ৫ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল। তবে মালিকদের মধ্যে ঐক্য না থাকার কারণে ভাঙন ধরেছে এই শিল্পে। ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেওয়ায় অসাধু বিশেষজ্ঞদের খপ্পরে কয়েক কোটি টাকা আটকা পড়ে কারখানার মালিকদের। এই নিয়ে কয়েকবার সালিশ করেছি তবে সেটার কোনো সুরাহ হয়নি। 

তিনি আরও বলেন, সাতক্ষীরার কলারোয়ায় তৈরিকৃত দোঁআশ মাটির এই টালি দেশের আর কোথাও তৈরি হয় না। তাই সরকারের উচিত সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে কারখানা মালিকদের সুবিধার ব্যবস্থা করে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা।

সাতক্ষীরা বিসিকের (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প করপোরেশন) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম সাকলাইন ঢাকা পোস্টকে জানান, কলারোয়ায় তৈরিকৃত টালি দীর্ঘ সময় যাবত সুনামের সঙ্গে ইউরোপ, আমেরিকারসহ অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়। তবে বিভিন্ন সংকটের কারণে সেখানকার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। তাদেরকে ইতোপূর্বে অনেকবার বলা হয়েছে বিসিকের নিবন্ধন নেওয়ার জন্য। নিবন্ধন নিলে তাদেরকে সরকারি সব সুযোগ সুবিধার দেওয়া সম্ভব হবে। এই শিল্পটি শুধু সাতক্ষীরা নয় দেশের একটি সম্ভাবনাময় শিল্প এটিকে টিকিয়ে রাখতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে ভালো প্রভাব ফেলবে। 

সোহাগ হোসেন/আরকে