আবদুল গফফার মুন্সী

রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনতে পান তিনি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। পরিবারকে না জানিয়ে মেজর হাতেম আলীর নেতৃত্বে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। তৎকালীন কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের গোড়া আমখোলাপাড়ার রাখাইনদের স্বেচ্ছায় দানকৃত সাতটি বন্ধুক নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আবদুল গফফার মুন্সী (৭০)।

আজ ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এই সুবর্ণজয়ন্তীতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংশোধিত পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের কথা রয়েছে। এতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ফিরে পাবেন তাদের হারানো সম্মান। আবার অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম না দেখে চাপা কান্নায় বুক ভাসিয়ে দেবেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল গফফার মুন্সী মহিপুর থানা সদরের নজীবপুর গ্রামের মৃত ইসমাইল মুন্সীর ছেলে। তার ভাষ্য অনুযায়ী, মহিপুর কো-অপারেটিভ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করাতে পারেননি তিনি। সাক্ষী-প্রমাণ থাকার পরও তালিকা প্রণয়নকারীদের বিশেষ চাহিদা মেটাতে না পারায় বাদ পড়েছেন, এমনটাই অভিযোগ করেন গফফার।

আবদুল গফফার মুন্সী ঢাকা পোস্টকে জানান, তার নেতৃত্বে প্রথমেই খাপড়াভাঙ্গা ইউনিয়নের শান্তি কমিটির ইউনিয়ন লিডার সেরাজ কমান্ডারের সেরাজপুর গ্রামের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এর দুই দিন পর মেজর হাতেম আলীর নেতৃত্বে বরগুনা জেলার বামনা থানার বুকাবুনিয়া গ্রামে প্রশিক্ষণে যাওয়ার জন্য রওনা হন তিনি। পথে তিনি, আনিসুর রহমানসহ মোট পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা বন্দি হন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। পরে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় কলাপাড়া থানায়। সেখানে নির্যাতনের পর অন্যদের ছেড়ে দেওয়া হলেও গফফার মুন্সীকে নিয়ে যাওয়া হয় পটুয়াখালী সার্কিট হাউসে। সেখানে পাকিস্তানি মেজর নাদের পারভেজের নির্দেশে অমানুষিক নির্যাতন শেষে পটুয়াখালী জেলে নেওয়া হয়। এদিকে ছেলের শোকে মা মৃত্যুবরণ করেন। অনেক অনুরোধ করলেও তার মায়ের লাশ তাকে দেখতে দেওয়া হয়নি।

এর প্রায় দুই মাস পর ভারতীয় সেনাবাহিনী পটুয়াখালী জেলের মধ্যে উড়োজাহাজ থেকে বোমা বর্ষণ করে। এ সময় জেলে অন্য বন্দীদের সঙ্গে গফফার মুন্সীও পালিয়ে বাড়িতে আসেন। একই দিন কলাপাড়া থানা মুক্ত হয় পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে।

গফফার বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘৃণা ও ভয়ে গফফার মুন্সী আত্মগোপনে চলে যান। যদি রাজাকাররা বঙ্গবন্ধুর মতো মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে ফেলে, এমন আশঙ্কা থেকেই আত্মগোপনে চলে যান তিনি। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়। ওই তালিকায় তার নাম না থাকায় আবেদন করেন তিনি। যার সিরিয়াল নম্বর ৬৮, ডিজি নম্বর ১৭৩৯। এরপর উপজেলা ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে একাধিকবার যোগাযোগ করেন তিনি। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করাতে পারেননি।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, এমন একাধিক সাক্ষী-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তালিকা প্রণয়নকারীদের বিশেষ চাহিদা পূরণ করতে না পারার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাবেক এমপি আবদুর রাজ্জাক খান, আবদুস ছত্তার মুন্সী, মো. ফজলুল হক, পল্লিচিকিৎসক অনিল চন্দ্র দাস আজ বেঁচে নেই। গফফার মুন্সী দাবি করেন, সরেজমিনে তদন্ত করলে সত্যতা বেরিয়ে আসবে। আমি কারও আবদার পূরণ করতে পারিনি।

তাই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে গফফার মুন্সীর একটাই দাবি, ভাতা চাই না, চাই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।

এ ব্যাপারে কলাপাড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আবদুস ছত্তার ফরাজী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গফফার মুন্সী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, আমরা তা জানি। ২৬ মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এখন আর তার নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কোনো সুযোগ নেই।

তিনি আরও বলেন, অবহেলার কারণে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও তার নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করাতে পারেননি, এটা তার নিজেরই ব্যর্থতা।

এনএ