আমরা কেউ চাই না অবৈধ পথে কেউ বিদেশে যাক। কিন্তু অনেকে পালিয়ে চলে যায়। অবৈধ পথে প্রবাসে পাড়ি দেওয়ার সময় একই এলাকার পাঁচজন মা সন্তানহারা হয়েছেন। সন্তান হারার শোক এখনও তারা ভুলতে পারেননি। এভাবেই ঢাকা পোস্টকে বলছিলেন স্বজনহারা সুনিতা রানী দাস।

ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পরিবারের সবার অমতে অবৈধ পথে ইতালির উদ্দেশে ঘর ছেড়েছিলেন শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার দক্ষিণ চাকধ গ্রামের উত্তম দাস। ফিরেছেন লাশ হয়ে। তবে প্রতিবেশীদের কেউ কেউ বলছেন উত্তমের লাশ বলে যে মরদেহ সৎকার করা হয়েছে তা উত্তমের নয়। নানা জনের নানা কথা শুনে কান থাকতেও যেন বধির হয়ে গেছেন স্বজনরা। একদিকে ছেলে হারানোর শোক, অন্যদিকে ঋণের বোঝা টানতে পাথর হয়ে গেছে উত্তম দাসের পরিবার।

নড়িয়ার চাকধ বাজারে মাছ বিক্রি করেন উত্তম দাসের বাবা গৌতম দাস। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভিন্নজনের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা সুদের ওপর নিয়েছি। তাদের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না।

তিনি বলেন, আমার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে লেখাপড়া করাব। তারপর এলাকায় একটি ওষুধের দোকান দিয়ে দেব। কিন্তু বাজারে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েই ওর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। আমার ছেলে ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা ছিল। লিবিয়ায় যাওয়ার পর পুলিশ উত্তমকে দেখে বলেছে, ‘তুই পুলিশে চাকরি করবি। তোর কেমন বাবা-মা? তোকে পাঠাইছে লিবিয়ায়।’

তিনি আরও বলেন, এই দেশে লেখাপড়া করে চাকরি পাওয়া যাবে না। চাকরির জন্য ২০-২৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হবে। লাভ হইব কী! এই হলো অবস্থা।

উত্তম দাসের ভাই অনন্ত দাস পড়াশোনা করেন নড়িয়া সরকারি কলেজে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভাইয়া দেশে ভালোই ছিল। আমরা আশা করছিলাম ওরে নিয়ে দেশেই ব্যবসা করব। কিন্তু, ২০১৮ সালে ভাইয়া তার ৪ বন্ধুসহ এলাকার আরও অনেকেই বিদেশ চলে গেল। যাওয়ার আগে আমরা অনেকের কাছ থেকে তাকে ঋণ করে টাকা দিছিলাম। কিন্তু যেভাবে তাকে নেওয়ার কথা ছিল দালালরা সেইভাবে ওরে নেয় নাই। এ কারণে দালালদের সঙ্গে তাদের বিরোধ তৈরি হয়েছিল। সেই বিরোধ থেকেই হয়তো কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছিল তাদের মাঝে। ওই ঘটনায় মারা গেছে আমার ভাই। পরে আমরা তার মরদেহ সরকারি মাধ্যমে পেয়েছিলাম। বাংলাদেশ থেকে রাষ্ট্রদূত গিয়েছিল। তার মাধ্যমে দুই মাস পরে আমরা ভাইয়ের মরদেহ পেয়েছি। বাকিদের লাশ তাদের পরিবার আজও পায়নি।

উত্তম দাসের চাচি সুনিতা রানী দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো সময় ওর নামে খারাপ কোনো রিপোর্ট বাড়িতে আসেনি। ভালোই ছিল সে। আগে একটু দুষ্টুমি করলেও বরিশাল থেকে পড়াশোনা করে আসার পরে বিএ অনার্সে ভর্তি করাইলাম। পড়ালেখাটা ঠিকমতোই করতো উত্তম। হঠাৎ করে একদিন দিকে এসে হুটহাট করে চলে গেছে। আমরা না করছি, আমার ছেলেও না করছে। আমার ছেলে বলেছে, আমরা তিন ভাই ডাল ভাত খাব, তাও অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার দরকার নাই। চাচাতো ভাইদের আমার ছেলে অনেক ভালোবাসতো। উত্তমের দুর্ঘটনার খবর শুনে এক সপ্তাহের জন্য আমার ছেলে ইতালি থেকে বাড়ি চলে আসছে।

এ বিষয়ে ভূমখাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলমগীর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঋণ করে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে ছেলে হারিয়ে পরিবারটি অসহায় অবস্থায় রয়েছে। তাকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সহযোগিতা করা হবে। যদি প্রশাসন ও প্রবাসীরা ওই পরিবারটির পাশে দাঁড়ায় তাহলে পরিবারটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

২০১৯ সালের ১০ মে উত্তম দাসের মতো একই এলাকার পারভেজ, জুম্মান, সুমনও লিবিয়া থেকে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার পথে মারা যায়। তাদের মধ্যে জুম্মনসহ অন্যদের লাশও পাওয়া যায়নি বলে ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন জুম্মান হাওলাদারের ভাই অয়ন হাওলাদার। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের দাবি, তাদের মতো আর কাউকে যেন এভাবে স্বজন হারাতে না হয়।

এবিএস