ভ্যানচালক মিরাজ মিয়া ও দেলোয়ার হোসেন। ছবি- ঢাকা পোস্ট

ময়মনসিংহ নগরীর জুবলিঘাট এলাকায় রাস্তার পাশে নিজের ভ্যানের উপর বসে গল্প করছিলেন মিরাজ মিয়া (৫০)। তার পাশে বসে সঙ্গ দিচ্ছিলেন দেলোয়ার হোসেন (৪০)। গল্পের বিষয়বস্তু কি বাজেট? এমন প্রশ্ন করতেই বাজেট শব্দটির সঙ্গেই যেন অপরিচিত মিরাজকে পাশেরজন বলছিলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়ে-কমে যে ওইটা।’ তাৎক্ষণিক মিরাজের জবাব, ‘বাজেট বুঝি না বাপু। বোঝার দরকারও নাই। এইডা তো আঙ্গর পেটে ভাত দিতো না। কাম পাইলে পেট চলে, বাজেট লইয়া চিন্তার সময় নাই।’

এভাবেই একটানা বলে গেলেন ময়মনসিংহ সদর উপজেলার কাতলাসেন এলাকা থেকে শহরে ভ্যান চালাতে আসা মিরাজ।

বাজেট নিয়ে কোনোরকম মাথাব্যথা নেই ওই এলাকার টং দোকানি নাজমুল মিয়ারও (২৬)। বাজেট নিয়ে জানতে চাইলে গোমড়ামুখে তার উত্তর, ‘বাজেটের খবর জাইন্যা কি আর হইবো। আঙ্গর তো আর কোনো পরিবর্তন হইতো না। দোহানদারি কইরা যা কামাই তা দিয়া কোনোরকমে সংসার চলে। দিন দিন সংসার চালানিই কঠিন হইয়া যাইতাছে। সবকিছুরই দাম বাড়ছে। আমরা যারা ছোটখাটো ব্যবসা করি, আঙ্গর ব্যবসায় লগ্নি বাইড়া গেছে কিন্তু লাভ তো আর বাড়ছে না। বাজেট জাইন্যা কি করমু, কাম কইরাই জীবন চালানো লাগবো।’

নাজমুলের দোকান থেকে পান নিয়ে খেতে খেতে নুরু মিয়া নামে এক রিকশাচালক কথার রেশ টেনে বলেন, ‘বাজেট বুইজ্যা লাভ আছে? রিকশার চাকা ঘুরাতে পারলে পকেটে টেহা আহে। হেই টেহা দিয়া বাজার সদাই লইয়া গেলে পেটে ভাত জুটে। এই শইলডাত যতদিন শক্তি আছে এইতাই কইরা বাইচ্যা থাকা লাগবো।’ 

দোকানি নাজমুল মিয়া। ছবি- ঢাকা পোস্ট

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন তরুণ। যাদের কয়েকজন বাজেটের খোঁজ নিচ্ছিলেন অনলাইন পোর্টালে। দেখছিলেন কোন কোন পণ্যের দাম বেড়েছে আর কমেছে, কোন খাতে কেমন বরাদ্দ ইত্যাদি। কেমন বাজেট হয়েছে জানতে চাইলে সুমন মাহমুদ নামে এক তরুণ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজেটের আকার বেড়েছে ঠিকই কিন্তু বাজেট গণমুখী হয়নি। নির্বাচনের বছর যেহেতু তাই গণমুখী একটি বাজেট দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু আমরা দেখছি যে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব কিছুর দামই বাড়ছে। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য সেটি নিশ্চয়ই ভালো হবে না।

তবে মারুফ হাসান নামে আরেকজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, তরুণ-তরুণীদের গবেষণায় বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকা রেখেছে সরকার। যার মাধ্যমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ও ইনোভেশন সেন্টারের মাধ্যমে ৮০ হাজার তরুণ-তরুণীকে অগ্রসর প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এটি একটি ভালো ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা বলে মনে করি।

সংসারের ব্যয় মেটাতে দিনে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির পাশাপাশি রাতে মুদি দোকানের ব্যবসা করেন সাইফুল ইসলাম। নগরীর সেহড়া এলাকায় বাজেট নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজেট যাই হোক না কেন, আমাদের মতো যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের এই ব্যবসা নিয়েই টিকে থাকতে হয়। এই বাজেট যদি আমাদের মতো ক্ষুদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পারে তবেই বাজেটের সার্থকতা থাকবে।

প্রস্তাবিত বাজেটের ভালো দিকের পাশাপাশি কিছু সংস্কার করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. তানজিল হোসেন।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ইনকাম ট্যাক্সের সীমা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে, মধ্যবিত্তের জন্য এটি ভালো উদ্যোগ। এতে মধ্যবিত্ত সোসাইটি কিছুটা হলেও কর রেয়াত পাবে। অন্যদিকে কিছু কিছু জিনিসের দাম বাড়ানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় নাভিশ্বাস, সেখানে নতুন করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ানোটা ঠিক হয়নি। এছাড়া স্বাস্থ্যখাতে আরও বরাদ্দ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সঠিকভাবে ইউটিলাইজেশনের মাধ্যমে ব্যয় করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আইএমএফের ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের জন্য জ্বালানি খাতের ভর্তুকি তুলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের এমনিতেই বিদ্যুৎ, তেল ও গ্যাসের দাম অনেক বেশি। আবার যদি ভর্তুকি তুলে দেওয়া হয় তাহলে কিন্তু ওইগুলোর দাম আরও বাড়বে। তাই ভর্তুকি তুলে দেওয়া উচিত হবে না।

খাদ্য নিরাপত্তা জোরদারে এবারও সরকার কৃষিতে গুরুত্ব দিয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. হাসনীন জাহান।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, এবারের বাজেট হবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে প্রথম বাজেট। তাই এবারের বাজেটে সংগত কারণেই কৃষি, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কমানো হচ্ছে কৃষি যন্ত্রপাতির দাম। এটি অবশ্যই কৃষি খাতের জন্য ভালো খবর। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় আসন্ন বাজেটে কৃষি, খাদ্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ১ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ালেও বর্তমান মূল্যস্ফীতির সময়ে এই বরাদ্দ অপ্রতুল। উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, সারে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকা। গত বছর এটি ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা কিন্তু গত বছর খরচ হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ গত বছরই যেখানে ২৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে এবার সেখানে ২৪ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। তাই আমরা অনুমান করতেই পারি যে এরচেয়ে বেশি খরচ হতে পারে। তাই কৃষি খাতে বরাদ্দটা আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার (১ জুন) বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন। যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম বাজেট। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদের ১৫তম বাজেট এটি।

এমজেইউ