মেলার বিশেষ আয়োজন বালিশ মিষ্টি

ফরিদপুরের বোয়ালমারীর রূপাপাত ইউনিয়নের কাটাগড় গ্রামের ধর্মীয় সাধক দেওয়ান শাগের শাহের (রহ.) মাজারের বার্ষিক ওরস উপলক্ষে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী কাটাগড় মেলা।

বৃহস্পতিবার (২৫ মার্চ) থেকে মাজার-সংলগ্ন এলাকায় তিন দিনব্যাপী মেলা শুরু হয়েছে। প্রতি বছরের ১১ চৈত্র (২৫ মার্চ) থেকে ১৩ চৈত্র (২৭ মার্চ) পর্যন্ত মেলা চলে। দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম এই মেলা আনুষ্ঠানিকভাবে তিন দিন হলেও মেলা চলে মাসব্যাপী।

কয়েকশ বছর আগে থেকে বাংলা সনের ১২ চৈত্র শাগের শাহের ওরসের পাশাপাশি বসে এই মেলা। মেলায় মাজারের ভক্ত নারী-পুরুষ ছাড়াও আশপাশের এলাকা থেকে প্রায় ১০ লাখ মানুষের আনাগোনা হয়। লাখো মানুষের আনাগোনায় মেলা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।

মেলার আয়োজক কমিটির সূত্রে জানা গেছে, তাদের পূর্বপুরুষদের মেলা আয়োজনের ধারাবাহিকতায় তারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। কয়েকশ বছর ধরে চলছে মেলার এ আয়োজন।

মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার প্রদর্শনী করা হয়

কাটাগড় মেলা এ এলাকার ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। মেলার সময় কাটাগড় গ্রামসহ আশপাশের কলিমাঝি, সূর্যনগর, সহস্রাইল, ভুলবাড়িয়া, মাইটকুমরা, গঙ্গানন্দপুর, ছত্রকান্দা, বন্ডপাশা, বয়রা, বামনগাতি গ্রামগুলোতে থাকে উৎসবের আমেজ।

ঈদের ছুটিতে বাড়ি না আসলেও এ সকল গ্রামের চাকরিজীবী ও পেশাজীবীরা মেলা উপলক্ষে গ্রামের বাড়িতে আসার জন্য সারাবছর অপেক্ষায় থাকেন। এছাড়া দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলার মানুষ এ মেলায় আসেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, মেলায় পাঁচ সহস্রাধিক দোকানপাট বসেছে। কসমেটিকস, পোশাক, মিষ্টি, ফার্নিচার, খাবার হোটেলসহ গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য মাটির হাড়িপাতিল সহ বিভিন্ন পণ্যর পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা।

মেলায় বসেছে আচারের বিভিন্ন দোকান

মেলায় রয়েছে মৃত্যুকূপ, নাগরদোলা, ট্রেনসহ নানা বিনোদনের উপকরণ। এছাড়া বিভিন্ন খাবারের দোকান রয়েছে। খাবারের দোকানগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের খাবার। 

যশোর থেকে মেলায় নাগরদোলা নিয়ে এসেছেন কবির শেখ। তিনি বলেন, প্রতি বছরই মেলায় আসি। ভালোই রোজগার হয়।অপেক্ষায় থাকি এ মেলার জন্য। মেলা তিন দিন হলেও আমরা থাকব ১৫ দিন।

মাগুরা থেকে মেলায় মৃত্যুকূপ নিয়ে এসেছেন আব্দুর রহমান। তিনি জানান, প্রতি বছরই মেলায় আসি। এ বছর এসেছি। লোকজন ভালোই উপভোগ করছেন। মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার প্রদর্শনী হয়। জনপ্রতি ৩০ টাকা করে নেওয়া হয়।

রাজধানী ঢাকা থেকে এসেছেন কাপড়ের দোকান নিয়ে শফিক শেখ। তিনি বলেন, প্রতিবার এ মেলায় আমরা আসি। কেনাবেচা ভালো হয়।

মেলার বিশেষ আয়োজন মিষ্টি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মেলায় শতাধিক মিষ্টির দোকান বসেছে। হরেকরকম মিষ্টির পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা।

গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থেকে এসেছেন দিনবন্ধু সাহা। তিনি মিষ্টির দোকান নিয়ে বসেছন। তিনি বলেন, বিভিন্ন রকমের মিষ্টি রয়েছে দোকানে। কেনাবেচা ভালো হয়।

মেলায় কাপড়ের দোকান

তিনি বলেন, আমাদের দোকানের বিশেষ আয়োজন বালিশ মিষ্টি। পিসপ্রতি মিষ্টি ২০০ টাকা। এছাড়া মোহনভোগ পিসপ্রতি ১০০ টাকা, সীতাভোগের পিস ১০০ টাকা, সম্মানীভোগ ১০০ টাকা, পানি তাওয়া ৫০ টাকা ও রাজভোগের পিস ৫০ টাকা। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি রয়েছে।

দিনবন্ধু সাহা আরও বলেন, প্রতি দিন ৫০০ পিস বালিশ মিষ্টি বিক্রি হয়। তিন দিনের মেলা হলেও আমরা ১৫ দিন থাকব। দোকানের পেছনেই মিষ্টি তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। টাটকা মিষ্টি বিক্রি করছি আমরা।

যশোর থেকে এসেছেন অসিম কুমার সাহা। তিনিও দিয়েছেন মিষ্টির দোকান। তিনি বলেন, দোকানে বিভিন্ন রকমের মিষ্টি রয়েছে। প্যারা সন্দেশ, সাগরভোগ, বালিশ মিষ্টিসহ বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি রয়েছে। প্রতি দিন প্রায় ৫০ হাজার টাকা কেনাবেচা হচ্ছে।

মধুখালীর বাগাট থেকে আসা দেবাশীষ দাস বলেন, মেলায় এসে ভালো লাগছে। করোনাকালীন কোথাও মেলা না হওয়ায় ঘর থেকেই বের হওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মেলা ঘুরে দেখলাম। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি দেখতে পেলাম। নিজেও মিষ্টি খেয়েছি, বাড়ির জন্যও নিয়ে যাচ্ছি। 

মেলায় বসেছে আচারের বিভিন্ন দোকান। দেড় শতাধিক আচারের দোকান রয়েছে মেলায়। জলপাই, বড়ই, চালতা, আমলকি, রসুন, গাজর, চেরিফল, আমড়া, আনারস, আমসহ অর্ধশতাধিক রকমের বাহারি আচার রয়েছে দোকানগুলোতে।

মাগুরা জেলার মুহম্মদপুর উপজেলার শাহজাহান মিয়া মেলায় আচারের পসরা নিয়ে বসেছেন। তিনি জানান, তার দোকানে জলপাই, বড়ইসহ বিভিন্ন ধরনের আচার রয়েছে। মেলায় আচারের চাহিদা রয়েছে। প্রতি কেজি আচার ২০০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে।

খুলনা থেকে এসেছেন শামসুর রহমান। তিনিও দিয়েছেন আচারের দোকান। তার সঙ্গে সহযোগিতায় রয়েছেন তার স্ত্রী আসমা খাতুন। শামসুর রহমান জানান, দেশের বিভিন্ন জেলার মেলায় তিনি আচারের দোকান দিয়ে থাকেন। আচারের ব্যবসাই তার পেশা। 

মেলায় আসা ব্যবসায়ী কাওসার শেখ বলেন, যশোর থেকে মেলায় এসেছি। পাশেই আত্মীয়বাড়ি, তাদের দাওয়াতে প্রতি বছরই মেলায় আসি। মেলায় এসে আচার কিনে নিয়ে যাই। 

মেলায় রয়েছে পাঁচ সহস্রাধিক দোকানপাট

কালিমাঝি গ্রামের মেয়ে সুফিয়া বেগম জানান, আমি স্বামী সন্তান নিয়ে ঢাকায় বসবাস করলেও শুধু মেলা উপলক্ষে বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। কেননা সারাবছর আমি অপেক্ষায় থাকি মেলার সময় বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসব বলে। 

বন্ডপাশা গ্রামের বাসিন্দা আফছার হোসেন জানান, মেলা থেকে সাজবাতাসা ও বিভিন্ন মিষ্টি কেনা হয়। পরে তা মাটির পাত্রে সব আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠানো আমাদের রেওয়াজ রয়েছে।

আলফাডাঙ্গা থেকে মেলায় সপরিবারে ঘুরতে আসা আসলাম শেখ বলেন, মেলায় এসে ভালো লাগছে। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এসেছি। ছেলে-মেয়েরা খুব আনন্দ করছে।

রূপাপাত ইউপি চেয়ারম্যান আজিজার রহমান বলেন, মেলায় মাঠের আয়তন প্রায় ৩ কিলোমিটার। এ বছর মেলায় বিভিন্ন পণ্যের পাঁচ সহস্রাধিক দোকানের পসরা বসেছে। মেলায় বিভিন্ন বিনোদন আয়োজনও রয়েছে। তবে মাটির খুঁটিতে চিনির তৈরি সাজবাতাসা কেনা এ মেলার অন্যতম ঐতিহ্য।

মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি মশিউল আজম বাবু মিয়া বলেন, মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ১০ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট বসেছে। বিশেষ আকর্ষণ বালিশ মিষ্টি। মিষ্টি দেখতেও ভালো, খেতেও ভালো।

এদিকে মেলায় আগতদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেখা যায়নি। মেলায় আসা বেশিরভাগ মানুষকেই মাস্ক পরিধান ছাড়াই ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। তবে মেলায় আসা দর্শনার্থীদের মাঝে সামান্য পরিমাণ মাস্ক বিতরণ করতে দেখা গেছে মেলার আয়োজক কর্তৃপক্ষকে।

অপরদিকে মেলায় স্টলের ভাড়া বাবদ অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার ব্যাপারটি অস্বীকার করেছেন মেলা কমিটির সভাপতি মশিউল আজম বাবু মিয়া।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা প্রায় পাঁচ হাজার দোকান-পাট মেলায় বসেছে। মেলায় খাবারের দোকান দেওয়া রমিজ শেখ বলেন, আমাদের দোকান বসানোর জন্য ৩ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো টাকা দেওয়া হয়নি।

পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসছেন দোকানিরা

কাপড়ের দোকানি সামাদ ফকির বলেন, আমার কাছে ৪ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে। আসলে কত টাকা দিতে হবে এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

দোকানভাড়ার বিষয়ে মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি মশিউল আজম বাবু মিয়া বলেন, দোকানদাররা যে টাকার কথা বলেছে; সেটা সঠিক নয়। এখানে স্টলের জন্য কারও কাছে কোনো টাকা চাওয়া হয়নি। সাধক দেওয়ান শাগের শাহের (রহ.) মাজারের উন্নয়নে যে যা দেবে, তাই নেওয়া হবে।

বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ঝোটন চন্দ জানান, মেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া জনসাধারণের নির্বিঘ্ন যাতায়াতে প্রশাসন সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।

বি কে সিকদার সজল/এমএসআর