ফাইল ছবি

নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গাইবান্ধার জনজীবন, পরিবেশ ও প্রাণিকুল। তপ্ত রোদে খা খা করছে জেলা শহর। শহরে প্রবেশের রাস্তাগুলোর বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা ছোট ছোট হাট-বাজারও পুড়ছে ছায়াহীন রোদে। স্বস্তি নেই পথচারী, ব্যবসায়ী ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের মাঝে। তীব্র গরম প্রভাব ফেলছে বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জীবনে। শুধু তাই নয়, কেটে ফেলা ওইসব গাছে বসবাস করা হাজারো পাখিও হয়েছে নীড়হারা।

গাইবান্ধায় রাস্তা প্রসস্তকরণের জন্য জেলা পরিষদের শতবর্ষী বিভিন্ন প্রজাতির একাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। গেল চার বছরে জেলায় সরকারিভাবেই কাটা হয়েছে লক্ষাধিক গাছ। এতো গাছ কাটা হলেও রোপণে নেওয়া হয়নি তেমন কোনো উদ্যোগ।

গাইবান্ধা বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০২০ ও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে একটি গাছও রোপণ করতে পারেনি গাইবান্ধার বন বিভাগ। তাদের দাবি এই দুই অর্থবছরে গাছ লাগানোর প্রকল্পে কোনো অর্থ বরাদ্দ না থাকায় বৃক্ষ রোপণ করা সম্ভব হয়নি। গেল পাঁচ বছরের মধ্যে কেবল ২০২১-২০২২ অর্থবছরে শহরের ঘাঘট নদীর ৩০ কিলোমিটার বাঁধে মাত্র ৩০ হাজার চারাগাছ রোপণ করেন তারা। কিন্তু গেল চার বছরে মাত্র ৩০ হাজার চারা রোপণ করলেও একই সময়ে জেলার বিভিন্ন রাস্তা প্রশস্তকরণ, রেলসড়ক সংস্কার, নদীর বাঁধ নির্মাণ ও গাছের মেয়াদোত্তীর্ণের কারণে কর্তন করা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ১ লাখ ৬ হাজার গাছ। শুধু তাই নয়, ২০০৩-২০০৪ অর্থবছর থেকে বিভিন্ন বছরে রোপণ করা আরও ১ লাখ ৫৬ হাজার গাছ কর্তনযোগ্য জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষের কাছে পত্রও দিয়েছে দপ্তরটি। যে কোনো সময় এর অনুমোদন পেলে কাটা হবে সেসব গাছও।

অপরদিকে শহরের যানজট নিরসন ও গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মহাসড়কের যথাযথ মান ও প্রশস্থতায় উন্নীতকরণে ২০১৮ সালে পলাশবাড়ী হাইওয়ে থেকে গাইবান্ধা শহরের পূর্বপাড়া পর্যন্ত ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক সম্প্রসারণের কাজ হাতে নেয় সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এর মধ্যে গাইবান্ধা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামন থেকে পূর্বপাড়া পর্যন্ত ২ দশমিক ৫ কিলোমিটার অংশ গাইবান্ধা শহরের পুরোপুরি ভেতরে পড়ায় ওই অংশটুকু ফোরলেনের উন্নীতকরণের সিদ্ধান্ত হয়। এতে সড়কটি ডিভাইডারসহ উভয় পাশে ১৮ ফুট সম্প্রসারণ করে ৩৬ ফুট চওড়ায় উন্নীতকরণ এবং রাস্তার উভয় পাশে ফুটপাত কাম ড্রেন করতে গিয়ে জেলা পরিষদের বিশাল বিশাল শতবর্ষী ২৬টি রেইনট্রি গাছ কাটা পড়ে। এছাড়া গাইবান্ধা সড়ক বিভাগের অধীন ‘গাইবান্ধা-গোবিন্দগঞ্জ ভায়া নাকাইহাট জেলা মহাসড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় সড়কটি প্রশস্তকরণে কাটা পড়ে জেলা পরিষদের আরও বেশ কিছু গাছ।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, নির্বিচারে গাছপালা নিধনের কারণে একদিকে বৃষ্টি কমছে, অন্যদিকে তীব্র উষ্ণতর হচ্ছে ভূপৃষ্ঠ। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, গরমিল হচ্ছে ঋতুর আবর্তনেও। সূর্যরশ্মির তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে গ্রিনহাউস ইফেক্ট। গাছপালার সঙ্গে সর্বদাই নির্দয় ও নির্মম আচরণ করে পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে মানুষই। 

গাইবান্ধায় সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করা হলেও কারও পক্ষে প্রকৃতি রক্ষায় বৃক্ষ রোপণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র পরিবেশ দিবস পালন করতে গিয়ে কিছু গাছ রোপণ করে সরকারি দপ্তরগুলো। যা পরিবেশের চাহিদা থেকে অনেক কম।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছের প্রতি নির্দয়তা-নির্মমতা পরিহার করে ফলদ, বনজ, ওষুধি ও শোভাবর্ধনকারী গাছপালার প্রয়োজনীয়তা ও কেটে ফেলার অপকারিতা সম্পর্কে জনসাধারণকে জানাতে সামাজিক সংস্থা ও সরকারি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরকে এখনই সক্রিয় হওয়ার তাগিদ সংশ্লিষ্টদের। একই সঙ্গে কৃত্রিম বন নির্মাণ, গাছের উপকারিতা নিয়ে শহর এবং গ্রামের পাড়া-মহল্লায় মিছিল-সভার আয়োজন করা এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গাছ লাগানোর বিষয়ে সভা-সেমিনারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গাছ লাগাতে আগ্রহী করে তোলার পরামর্শ পরিবেশবিদ, সচেতন মহল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের। অন্যদিকে গাছ কর্তনকে গণঅপরাধের সঙ্গে তুলনা করে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে জেলায় কয়েক হাজার অতি প্রয়োজনীয় বৃক্ষ রোপণের দাবি পরিবেশবাদী সংগঠন ও সচেতন মহলের।

পরিবেশ আন্দোলন গাইবান্ধার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হক জনি বলেন, মানুষের জন্য যে উন্নয়ন সে উন্নয়ন করতে যদি প্রকৃতিই ধ্বংস করা হয় তা জীব-বৈচিত্রের জন্য কখনোই কল্যাণকর হবে না। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করা হলেও কারো পক্ষেই প্রকৃতি রক্ষায় বৃক্ষ রোপণে সারা বছরই কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। শুধুমাত্র পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করতে গিয়ে কিছু গাছ রোপণ করে সরকারি দপ্তরগুলো। যা পরিবেশের চাহিদা অনুযায়ী অনেক কম। তিনি সারা বছর অধিক পরিমাণ গাছ লাগাতে বন বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। 

গাইবান্ধা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এএইচএম শরিফুল ইসলাম মন্ডল বলেন, দেশের উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট ব্যাপার যেমন- বাঁধের রিপিয়ারিং ও রাস্তা প্রশস্তকরণের কারণে গাছ বেশি কাটা হয়ে থাকে। তবে বাঁধ ও রাস্তার কাজ পুরোপুরিভাবে শেষ হলে ওই সকল স্থানে পুনরায় গাছ লাগানো হয়। অর্থ বরাদ্দ কম থাকায় বিগত কয়েক বছরে এ জেলায় গাছ কম রোপণ করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক অলিউর রহমান বলেন, বৃক্ষ রোপণের বিষয়টি বন বিভাগ দেখে থাকে। তাদের কাজেই সারা বছর বৃক্ষ রোপণ করা। তারা পরিপূর্ণ গাছ কাটবে, কিন্তু যা কাটবে তার থেকেও বেশি পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে। 

গাছ লাগানোর প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ না থাকার কারণে বৃক্ষ রোপণ বন্ধ রাখার বিষয়টি বন বিভাগের সমন্বয়হীনতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অর্থ বরাদ্দ নেই এমন অজুহাতে গাছ রোপণ বন্ধ রাখার সুযোগ নেই। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জেলায় বেশি বেশি গাছ রোপণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান তিনি।

রিপন আকন্দ/আরএআর