সানজিদা ও সাবরিনা

ফুটফুটে দুই বোন সানজিদা-সাবরিনা। একসঙ্গে স্কুলে আসা-যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া আর খেলাধুলা করে। দুই কন্যার এমন চঞ্চলতা দেখার পরও সারাক্ষণ কাঁদছেন তাদের মা-বাবা। কারণ সানজিদা-সাবরিনার জন্মই যেন আজন্ম পাপ। তারা গ্রোথ হরমোন রোগে আক্রান্ত। ফলে অন্য আর আট-দশজনের মতো স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না ছোট্ট এই দুই শিশু।

দেখতে তিন বছরের শিশু মনে হলেও জন্মসনদ অনুযায়ী যমজ এই দুই বোনের বয়স নয় বছর। তারা দুজন পড়ছে পীরগঞ্জ উপজেলার ছোট মীর্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে। বাংলা, ইংরেজি, অংক সব বিষয়ে সানজিদা-সাবরিনা সিদ্ধহস্ত।  

রংপুর জেলার পীরগঞ্জের ছোট মির্জাপুর গ্রামের সাজেদুল-নার্গিস দম্পতির যমজকন্যা সানজিদা আক্তার মাহি ও সাবরিনা আক্তার মুক্তা। এই দুই বোনের বয়স যখন ছয় বছর, তখনো দেখতে ছোট্ট শিশুর মতো। বয়স বাড়লেও তাদের শারীরিক বৃদ্ধি না হওয়ায় দুশ্চিন্তা বাড়ে মা বাবার। শরণাপন্ন হন চিকিৎসকের। মাসে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা ব্যয় হওয়ায় শুরু করতে পারেননি চিকিৎসা। তাই চোখের সামনে অবুঝ দুই শিশুর এমন পরিণতি সইতে না পেরে সব সময় অশ্রু ফেলছেন হতভাগা মা-বাবা। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সানজিদা-সাবরিনাকে ১৫-১৬ বছর বয়স পর্যন্ত গ্রোথ হরমোন রোগের চিকিৎসা করাতে হবে। আর এজন্য গরিব মা-বাবাকে জোগাড় করতে হবে ৪২ লাখ টাকা।

অসহায় বাবা সাজেদুল ইসলাম বলেন, আমার মেয়েদের বয়স ৯ বছর চলছে, তাদের দুজনকে ১৫-১৬ বছর বয়স পর্যন্ত হরমোন ইনজেকশন দিতে হবে। এটা খুবই ব্যয়বহুল। আমার অবস্থা খুবই খারাপ। আমার বাড়িঘর বিক্রি করেও আমি মেয়েদের চিকিৎসা করাতে পারব না। আমার সেই সামর্থ্য নেই। এখন ওরা প্রতিবন্ধী হয়েই বেঁচে থাকবে, চোখের সামনে সন্তানের এমন কষ্ট আমি বাবা হয়ে কীভাবে সইবো।

অশ্রুসিক্ত চোখের পানি মুছতে মুছতে মা নার্গিস বেগম বলেন, এক বছর ধরে চিকিৎসা করাতে পারছি না। শুধু ডাক্তার দেখাতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। আমরা অনেক চেষ্টা করছি। কিন্তু এখন আর চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। 

চিকিৎসা করতে না পারায় চোখের সামনে সন্তানদের ধুঁকে ধুঁকে শেষ হওয়া দেখতে হচ্ছে অভাগা এই দম্পতিকে। তাইতো দুই মেয়েকে বাঁচাতে কেঁদে কেঁদে সবার কাছে সহযোগিতা চাইলেন তারা।

নার্গিস বেগম বলেন, আমার মেয়েদের উচ্চতা কম। ওরা অন্য আর সবার মতো স্বাভাবিকভাবে বাড়ছে না। এটা নিয়ে গ্রামের মানুষজন নানা কটু কথা বলে। এসব কথা শুনলে মেয়ে দুটো কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমি তো ওদের বোঝাতে পারি না, ওদের কি অসুখ হয়েছে।

সাজেদুল ইসলাম বলেন, আমার সংসার চালানোরই টাকা থাকে না। এ কারণে আমি স্থানীয় সমাজসেবা অফিসে কথা বলেছি। মেয়েদের চিকিৎসার জন্য সহায়তা চেয়েছি। আমাকে একটা কার্ড (ভাতা সুবিধা) করে দিয়েছে, সেখান থেকে আমি প্রতি মাসে ৭০০ টাকা পাই। কিন্তু ৭০০ টাকা দিয়ে তো মেয়েদের চিকিৎসা করা সম্ভব না। আমি দেশের মানুষের কাছে আমার মেয়ে দুইটার চিকিৎসার জন্য সাহায্য চাই, সহযোগিতা কামনা করছি। 

এদিকে প্রতিদিনই সানজিদা-সাবরিনাকে দেখার পাশাপাশি তাদের মা-বাবাকে সান্ত্বনা দিতে আসেন প্রতিবেশীরা। দ্রুত সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় শিশু দুটি সুস্থ হয়ে উঠবে বলে আশা তাদের। 

ছোট মির্জাপুরের বাসিন্দা জরিনা বেগম বলেন, বাচ্চা দুইটাকে দেখি, তারা একসঙ্গে খেলাধুলা করে। কিন্তু খুব খারাপ লাগে। অনেকদিন ধরে ওদের দুইজনকে যে রকম দেখেছি এখনো সেই রকমই আছে। শুনেছি একটা অসুখ হয়েছে। ওদের বাবা-মার তো সামর্থ্য নেই চিকিৎসা করবে।

স্থানীয় মকবুল হোসেন বলেন, ওদের খাওয়া-দাওয়ার সমস্যা। ওরা খুব ভালো খাবারও খেতে পারে না। ভালো চিকিৎসাও হচ্ছে না। এই দুটি বাচ্চার জন্য আমাদের সবার এগিয়ে আসা উচিত। দেশের বিত্তবান দানশীল মানুষেরা এগিয়ে আসলে বাচ্চা দুটির চিকিৎসা সম্ভব।

রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজী বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সমীর কুমার তালুকদার বলেন, শিশু দুটিকে সুস্থ করতে চাইলে প্রতিদিন গ্রোথ হরমোনের ইনজেকশন দিতে হবে। যার মাসিক ব্যয় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। 

তিনি আরও বলেন, গ্রোথ হরমোন রোগের কারণে শিশু দুটির স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। এটা একটা রোগ। হরমোন রিপ্লেসমেন্ট করতে পারলে ওদের বেড়ে ওঠা তখন স্বাভাবিক হবে। কিন্তু এই গ্রোথ হরমোন আমাদের দেশে তৈরি হয় না, এটা বিদেশ থেকে আসে। এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল। আবার চিকিৎসা করালে এটা এক দিন দুই দিনেও ভালো হবে না, এজন্য কমপক্ষে ১৫ থেকে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু দুটিকে এই গ্রোথ হরমোনের ইনজেকশন দিতে হবে। 

এখন থেকে চিকিৎসা করতে না পারলে সানজিদা ও সাবরিনা আর বাড়বে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই চিকিৎসক।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর