‘আমি টেম্পুর কাজ শিখি ১৯৬২ সালে। দেশ স্বাধীনের পর টেম্পু চালানো শুরু করি। টেম্পু চালাতে চালাতে মেকানিকের কাজ শিখেছি। ৩০ বছর টেম্পু চালিয়েছি। মেকানিকের কাজ করেছি প্রায় ২৫ বছর। এখন টেম্পুও নাই, টেম্পুর কাজও নাই। আমার জীবন যৌবনের সিংহভাগ সময় খেয়ে এখন টেম্পুই গায়েব হয়ে গেছে। এখন আমি বেকার।’

এভাবেই ঢাকা পোস্টকে কথাগুলো বলছিলেন ৭০ বছর বয়সী টেম্পু মেকানিক আব্দুল হামিদ। তার দাবি- রাজশাহীতে এখন তিন থেকে চারটা টেম্পু আছে বলে মিস্ত্রি হিসেবে নামটা রয়েছে তার। কারণ টেম্পু বিলুপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে  মিস্ত্রিরা পেশা পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু আব্দুল হামিদ এখনো এই পেশায় রয়ে গেছেন।

জীবন-জীবিকা পরিচালনার একমাত্র কাজটিও ঠিকঠাক না থাকায় হতাশ আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, টেম্পু উঠে গেল ইমা (হিউম্যান হলার) আসার কারণে। যে দুই-একটা ছিল তাও আবার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এসে হারিয়ে গেছে। কেউ কোনো দিন ভাবেনি টেম্পু এভাবে একবারে হারিয়ে যাবে। এখন টেম্পু খুঁজে পাওয়া যায় না। রাজশাহীতে তিন-চারটা টেম্পু আছে, সেগুলো আমাকেই ঠিক করতে হয়। এগুলো আর যাত্রী পরিবহণ করে না। কোম্পানির ভাড়া মারে। রাজশাহীতে একজনও টেম্পুর মিস্ত্রি নেই। যারা ছিলেন তারা অন্য কাজ করেন। তারা টেম্পু মেরামত করেন না।

জানা গেছে, আশির দশকে চলাচলের সহজ পরিবহন ছিল টেম্পু। ছোট পরিবহন হলেও জেলা শহরের কাছাকাছি যাতায়াতের এই মাধ্যামটির সড়কে ছিল একক আধিপত্য। দূরপাল্লায় যাত্রী পরিবহনে বাস, কার, মাইক্রোবাসের পরের স্থান ছিল টেম্পু। কম ভাড়া, আর যাতায়াতে সুবিধার কারণে মানুষের কাছে এই পরিবহনটি গণপরিবহনে রূপ নেয়। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে গ্যাসে চালিত ইমার (হিউম্যান হলার) কারণে লাগামে টান পড়ে টেম্পুর। ফলে সংকোচিত হয়ে যায় টেম্পুর সড়ক। এমন অবস্থায় ইমার দখলে আসে রাজপথ। কিন্তু সেই দখল বেশি দিন রাখতে পারেনি ইমা। ২০১০ সালের শুরুর দিকে রাজশাহীর সড়কে নামে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এতে টেম্পু হারিয়ে গেলেও কোনো মতে টিকে আছে কিছু ইমা গাড়ি।

টেম্পু মালিক ও চালক সূত্রে  জানা গেছে, আশির দশকে টেম্পুর দাম ছিল ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে। সেই সময় রাজশাহীতে কমপক্ষে ৭০০ টেম্পু চলাচল করত। এর মধ্যে ১০ সিটের টেম্পু ছিল ভারতের বাজাজ কোম্পানির। এই টেম্পু টু-স্ট্রোক গাড়ি। এছাড়া ছিল কিষাণ ও কাওয়াসিকি কোম্পানির টেম্পু। তবে কিষাণ কোম্পানির টেম্পু ছিল আকারে বড়। এতে আসন ছিল ১৪ সিটের। বড় টেম্পুগুলোতে একজন হেলপার লাগতো। আর ছোটগুলোতে চালক নিজেই টাকা তুলতেন। রাজশাহীতে ২০০৩ সালের দিকে গ্যাসে চালিত ইমা (হিউম্যান হলার) সড়কে আসার পরে জ্বালানিতে চালিত এই টেম্পু লাগামে টান পড়ে। কারণ জ্বালানির চেয়ে গ্যাসে খরচ কম হওয়ায় সেই সময় অনেকেই টেম্পু বিক্রি করে ইমা গাড়ি কেনেন। একই সঙ্গে জ্বালানির গন্ধে চোখ জ্বালা করা ও গাদাগাদি করে টেম্পুর মধ্যে বসে থাকা থেকে রক্ষা পেতে যাত্রীরা ইমা গাড়ির দিকে ঝোঁকেন। এরপর অল্প সময়ের মধ্যে টেম্পুগুলো হঠাৎ বাতিল হয়ে গেল। সেগুলো নিয়ে যাওয়া হলো উপজেলার গ্রাম পর্যায়ে। কিন্তু সেখানেও টিকতে পারলো না টেম্পুগুলো। 

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন- আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধার কারণে হারিয়ে গেছে টেম্পু, প্যাডেলের রিকশা ও মিশুক গাড়ি।

রাজশাহীতে বর্তমানে হাতেগনা তিন থেকে চারটি টেম্পু রয়েছে। এসব টেম্পু বিভিন্ন বিস্কুট-বেকারি কোম্পানিতে রয়েছে। তার মধ্যে একটি টেম্পু চালান কাটাখালীর রাব্বানি। 

রাব্বানি ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিনের পেশা ছাড়তে পারিনি। এখনো টেম্পু চালাই। বিস্কুট কোম্পানির মাল ডেলিভেরির কাজ করি। অন্য কাজ শেখা হয়নি। এই টেম্পু চালাতে পারি, তাই টেম্পুই চালাই। আমার ভালোই লাগে।

এক সময়ে টেম্পুর মালিক ও চালক ছিলেন রাজশাহী নগরীর বুধপাড়া এলাকার মুকলেস হোসেন ও সফিকুল ইসলাম সফি। সফিকুল ইসলাম সফি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের দুইটা টেম্পু ছিল। বাবা (মো. হান্নান) টেম্পুগুলো দেখা শোনা করতেন। একটা টেম্পু আমি চালাতাম। আর একটা ভাড়া দিয়েছিলেন বাবা। তখন টেম্পুতে ভালোই উপার্জন হতো। আমাদের এলাকায় আরও কয়েকজন টেম্পু চালাতেন। তাদের মধ্যে রয়েছে রাজু আহমেদ, আজিজুল ইসলাম কালু, আমিরুল ইসলাম। এর মধ্যে আমিরুল টেম্পুর মেকানিক ছিলেন। ইমা গাড়ি আসার পরে টেম্পু উঠে গেল। অটোরিকশা আসার পরে ইমার কদরও কমে গেল। গ্যাসের গন্ধের কারণে মানুষ ইমাতে উঠতে চাইতো না। তখন আজিজুল, রাজু ও আমি (সফি) অটোরিকশা চালাতে শুরু করি। আর ইমা গাড়িতে থেকেই গেল মুকলেস। পরে আমিরুল টেম্পুর মেকানিকের কাজ ছেড়ে অটোরিকশার ব্যাটারির পানি বিক্রির দোকান দেয়। এখনো তার দোকান রয়েছে।

এক সময় টেম্পুতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন নগরীর তালাইমারীর বাসিন্দা শামীম হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক সময় একমাত্র যানবাহন ছিল টেম্পু। খুব কাছে যাতায়াতে প্যাডেলের রিকশা। আর শহর বাজারে যেতে টেম্পু। এই অটোরিকশার আগে টেম্পুই একমাত্র চলাচলের সহজ ও কম ভাড়ার যানবাহন ছিল। এখন টেম্পুও নেই, প্যান্ডেলের রিকশাও নেই। টেম্পুর বদলে এসেছে ব্যাটারিচালিত অটো। আর প্যাডেল রিকশার বদলে এসেছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। 

রাতুল বেকারির প্রোপাইটর মানিক সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন টেম্পু নেই। তবে দুইটা মিশুক আছে। এখন সড়কে মিশুকও দেখা যায় না। আমরা কোম্পানির কাজের জন্য রেখেছি। চার বছর আগে ৩৫ হাজার করে টাকা দিয়ে দুইটা কিনেছিলাম।

প্যাডেলের রিকশা চালান রাজশাহীর পবা উপজেলার কুখুন্ডি গ্রামের তসের আলী। তসের আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৭-১৮ বছর বয়স থেকে রিকশা চালাই। এখন আমার বয়স ৭০ এর ঘরে। আল্লাহ সুস্থ রেখেছেন, কাজ করে খাচ্ছি। ছেলেরা আছে, তারা আলাদা থাকে। আমি কাজ করি আমার সংসার চালাই।

টেম্পু মেকানিক আব্দুল হামিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন আমি বেকার। তবে মাঝে মধ্যে রাজশাহীর কাঠাখালীতে রাব্বানির টেম্পু ঠিক করতে যাই। আর সপুরার বিসিকে একটি কোম্পানির টেম্পু আছে। তাদের টেম্পুর সমস্যা হলে আমাকে ডাকে। আমি গিয়ে ঠিক করে দিয়ে আসি। আমার দোকানে আসলাম, রাবিউল, নাজমুল, নয়ণ, সুমন, খোকন, তাইজুল কাজ করত। এখন তারাও নাই, টেম্পুও নাই, গ্যারেজও নাই। রাজশাহীতে যে কয়েকটা টেম্পু আছে আছে সবগুলোই বিস্কুট ফ্যাক্টারিতে চলে।

তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পর টেম্পুর একচেটিয়া দাপট ছিল সড়কে। তখন প্যাডেল রিকশা আর টেম্পু ছাড়া সড়কে ছোট যানবাহন ছিল না বললেই চলে। তখন ভালো ভাড়া হতো। সংসারও ভালো চলতো। টেম্পুর মাহাজনকে (মালিক) জমা বাবদ প্রতিদিন ৩০০ টাকা দিতে হত। আর আমাদের ৩০০ টাকা থাকতো। তখন ৩০০ টাকাই অনেক। আমার টেম্পুর গ্যারেজ ছিল তালাইমারী শহিদ মিনার এলাকায়। সেই সময়ে এখানে প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকার টেম্পু মেরামত বাবদ উপার্জন হত।

এক সময়ের টেম্পু চালক এনামুল হক এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান। তিনি রাজশাহী নগরীর রায়পাড়ার বাসিন্দা। দীর্ঘ ১৫ বছরের টেম্পু চালানোর অভিজ্ঞতা ভুলে হাতে তুলে নিয়েছেন অটোরিকশা। 

এনামুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০০১ সালে বাজাজ কোম্পানির টেম্পু চালিয়েছি। দীর্ঘদিন টেম্পু চালিয়েছি। ২০১১ সালে প্রথম অটোরিকশা আসে। সেই বছরই আমি ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়  অটোরিকশা কিনে চালাতে শুরু করি। এক যুগেরওূ বেশি সময় ধরে আমি অটোরিকশা চালাচ্ছি। এখন আমার দুইটা অটোরিকশা। একটা সকালে ও একটা বিকেলে চালাই।  

তিনি বলেন, তখন টেম্পু রুট হিসেবে চলাচল করত। অটোরিকশার মতো না। টেম্পুর চালককে সাত দিন সাত রুটে চালাতে হতো। একদিন বাজার থেকে কাটাখালী। একদিন কোর্ট, গোরহাঙ্গা থেকে নওহাটা রুটে। এছাড়া শহরের বাইরেও গাড়ি চালাতে হতো। গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ি, কাঁকনহাট, পবার দামকুড়া এসব রুটে টেম্পু চালাতে হতো। প্রতিটা রুটে মাস্টার ছিল। তখন বাজার থেকে কাটাখালীর ভাড়া ছিল ৫ টাকা। কোর্ট থেকে গোরহাঙ্গা রেলগেট ছিল ৩ টাকা। রেলগেট থেকে কাটাখালী ছিল ৫ টাকা। বড় টেম্পুগুলোতে একজন হেলপার থাকতো। ছোটগুলোতে থাকতো না।

রাজশাহী গোরহাঙ্গা রেলগেটে টেম্পুর চেইন মাস্টার ছিলেন মামুন ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অবাক করার মতো ঘটনা। কিছু দিনের মধ্যে টেম্পু গায়েব হয়ে গেল। শুধুমাত্র ইমা আর অটোরিকশা আসার কারণে এই টেম্পু ও মিশুক শহর ছাড়া হয়ে গেল।

রাজশাহী হিউম্যান হলার (ইমা) মালিক সমিতির সভাপতি শরিফুল ইসলাম শরিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইমার অবস্থা খারাপ। এখন সড়কে ৩০ থেকে ৪০টা  ইমা চলাচল করে। অটোরিকশা আসার পরে লোকসানের কারণে অনেকেই চালায় না ইমা। বাড়িতে ফেলে রেখেছে।

রাজশাহী জেলা মিশুক-সিএনজি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিদার হোসেন ভুলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, টেম্পুগুলো দুই স্ট্রোক ইঞ্জিন বিশিষ্ট ছিল। তেল খরচ বেশি। আবার ধোঁয়া হতো। টেম্পু মালিক সমিতির কাউকে এখন আর দেখা যায় না। একই সঙ্গে রাজশাহীতে টেম্পুও দেখা যায় না। আমার জানা মতে রাজশাহীতে প্রায় ৭০০ টেম্পু ছিল। এই টেম্পুগুলো একবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। 

আরএআর