অভিযুক্ত উজ্জ্বল সর্দার

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে গরুর পাটক্ষেত খাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে প্রকাশ্যে দুই কৃষককে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মী উজ্জ্বল সর্দার ও তার লোকজন এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ নিহতদের পরিবারের। প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় উজ্জ্বল চাঁদাবাজি, অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন, টেন্ডারবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত বলেও অভিযোগ রয়েছে।

দুই কৃষককে হত্যার ঘটনায় দৌলতপুর থানায় উজ্জ্বল সর্দারকে প্রধান আসামি করে ৩২ জনের নামসহ ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করা হয়েছে। মামলার ছয় আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছেন প্রধান অভিযুক্ত উজ্জ্বল সর্দার। তবে তার বাড়ি থেকে একটি ওয়ান শুটারগান, ছয়টি রামদাসহ বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ।  

গত বুধবার (১৪ জুন) বিকেলে উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের হাটখোলাপাড়া গ্রামের মালিথাপাড়া এলাকায় রামদা দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে বজলু মালিথা (৪২) ও শরিফুল মালিথাকে (৪৩) হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মালিথা বংশের  প্রায় ১৫ জন আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় নিহত বজলু মালিথার বাবা নাহিদ মালিথা বাদী থানায় মামলা করেছেন। 

আরও পড়ুন : কুষ্টিয়ায় দুই কৃষক হত্যা : বিচারের দাবিতে মানববন্ধন-বিক্ষোভ

নিহত শরিফুল মালিথা স্ত্রী চায়না খাতুন ও ছেলে গোলাম বলেন, বুধবার বিকেলে উজ্জ্বল সর্দারের নেতৃত্বে তার বাহিনীর  অস্ত্রধারী লোকজন বাড়িতে হামলা করে। এ সময় উজ্জ্বল ও তার লোকজন রামদা দিয়ে বজলু ও শরিফুলকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করে। এ সময় উজ্জ্বল, জালাল ও মান্নান সর্দারের হাতে পিস্তল ও রামদা ছিল। তারা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। উজ্জ্বল সর্দারের লোকজনের হামলায় অনেকেই গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। 

নিহত বজলু মালিথার স্ত্রী নাজমা খাতুন ও ছেলে মাসুদ মালিথা বলেন, উজ্জ্বল সর্দারের ভাগনে ফরিদ আলীর ক্ষেতের পাট খেয়ে ফেলে স্থানীয় শ্যামল আলীর গরু। এ নিয়ে ফরিদ ও শ্যামলের মধ্যে বিরোধ হয়। তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ফরিদকে মারধর করেন শ্যামল। শ্যামলের সঙ্গে বন্ধুত্ব একই এলাকার মালিথা বংশের তুষারের। পরে উজ্জল সর্দারের ক্যাডার তুফান আলী এলাকায় রটিয়ে দেন যে ফরিদকে মারধরে তুষার ইন্ধন জুগিয়েছে। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে উজ্জ্বল। উজ্জ্বল মানতে পারেননি যে তার ভাগনের গায়ে কেউ হাত তুলতে পারে। ফলে সামান্য ঘটনাকে পুঁজি করে মালিথা বংশের লোকদের ওপর হামলা চালায় উজ্জ্বল ও তার লোকজন।

স্থানীয়রা বলেন, হাটখোলাপাড়া গ্রামের মৃত আলিম সর্দারের ছেলে উজ্জ্বল সর্দার (৪৭) বিগত বিএনপি সরকারের সময় ওই দলের একজন চিহ্নিত ক্যাডার ও স্থানীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লালচাঁদ বাহিনীর সদস্য ছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর লালচাঁদ বাহিনী দৌলতপুরের চরাঞ্চলের মানুষের কাছে ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। পরে এই বাহিনীর প্রতিপক্ষ হিসেবে ছাপাত-পান্না বাহিনী গড়ে ওঠে। সেসময় ছাপাত-পান্না বাহিনীর ভয়ে উজ্জ্বল দেশের বাইরে চলে যান। বছর পাঁচেক আগে এলাকায় ফিরে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য (এমপি) আ ক ম সরওয়ার জাহান বাদশাহর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। এরই সুবাদে উজ্জ্বল এলাকার অবৈধ বালুঘাট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেন। পাশাপাশি তিনি এলাকায় নতুন করে সন্ত্রাসী বাহিনীও গড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। 

 ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে উজ্জ্বল সর্দার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে হঠাৎ উজ্জ্বলকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী   আ ক ম সরওয়ার জাহান বাদশাহর পক্ষে নির্বাচনী প্রচরাণায় অংশ নিতে দেখা যায়। উজ্জ্বল অনেকদিন ধরে পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছেন। এছাড়া তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদারি কাজ করেন। 

আরও পড়ুন : গরুর ফসল খাওয়া নিয়ে সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ১৫ 

কুষ্টিয়া-১ আসনের (দৌলতপুর) সংসদ সদস্য আ ক ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জমির ফসল খাওয়াকে কেন্দ্র করে সর্দার গ্রুপের হামলায় বজলু মালিথা এবং শরিফুল মালিথা নিহত হয়েছেন। এটা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক বিষয়। তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে হঠাৎ করে এ ঘটনা ঘটেছে। তাদের মৃত্যুতে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে আমার মনোনয়ন নিশ্চিত জেনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারা পরিকল্পিতভাবে কয়েকদিন ধরে এলাকায় উত্তাপ ছড়াচ্ছে, আমাকে নিয়ে মিথ্যাচার করছে, ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। তাদের ন্যাক্কারজনক আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ঘটনাস্থলে সরাসরি উজ্জ্বল সর্দার উপস্থিত ছিল না। তবে তার লোকজন ও তার বংশের লোকজন ছিল। উজ্জ্বল সর্দার দলের একজন কর্মী। একজন কর্মীর সঙ্গে নেতার যেমন সম্পর্ক থাকে স্বাভাবিক-সুন্দর, তার সঙ্গেও আমার তেমন সম্পর্ক। এর বেশি কিছু না। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যারা প্রকৃত দোষী আইননুসারে তাদের শাস্তি হবে। তদন্তে ঘটনার রহস্য উন্মোচন হবে। অপরাধীদের শাস্তি হবে ইনশাআল্লাহ। 

এ বিষয়ে উজ্জ্বল সর্দারের স্ত্রী মাসেদা খাতুনের বলেন, হত্যার ঘটনার সঙ্গে আমার স্বামী জড়িত না। তিনি ওই সময় তিনি এলাকায় ছিলেন না। এমপি বাদশাহর সঙ্গে আমার স্বামীর ভালো সম্পর্ক। আমার স্বামী নির্দোষ। 

দৌলতপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবর রহমান বলেন, গরু পাটক্ষেত খাওয়াকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় দুইজনের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলার ছয় আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

রাজু আহমেদ/আরএআর