ইনসেটে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু

গ্রামজুড়ে এত বড় ফটকের বাড়ি আর দ্বিতীয়টি নেই। দেওয়ালে টাইলস করা। তবে সন্ধ্যা হলেও ভেতরের দোতলা বাড়িতে নেই কোনো আলো। অন্ধকারাচ্ছন্ন বাড়ির সদর দরজায়ও ঝুলছে তালা। বাড়ির প্রধান ফটকের পশ্চিম পাশে লেখা ‘শেখ হামিদ ও ছাবেদা ভিলা।’

বাড়িটি আলোচিত বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতা ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর। বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার আডুয়াডিহি গ্রামের পুলিশের প্রয়াত উপপরিদর্শক শেখ আবদুল হামিদ ও ছাবেদা বেগম দম্পতির বড় ছেলে তিনি।

সরেজমিনে উপজেলার কোদালিয়া ইউনিয়নের আড়ুয়াঢিহি গ্রামের ওই বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানান, তাদের পরিবারের কেউ এখানে থাকেন না। বাড়িটি ফাঁকাই পড়ে থাকে। ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর ছোট ভাই পান্না এলাকায় আসেন। কয়েক বছর আগে বাড়ির ফটকের পূর্ব পাশে নিজেদের জমিতে মসজিদ করে দিয়েছেন তারা। 

আরও পড়ুন : ৫৮ মামলার চার্জশিটেই বাচ্চুকে আসামি করেছে দুদক

চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে পরিবারের সবার বড় শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। তার অন্য ভাইবোনেরা হলেন- শেখ ওয়াহিদুজ্জামান, শেখ খালেকুজ্জামান, শেখ শাহরিয়ার পান্না, শেখ সায়িদা ভুলু, শেখ মমতাজ রুমি, শেখ শিউলি ও শেখ জনি।  শেখ আবদুল হাই স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। এলাকার সবাই বাচ্চুকে চেনেন দানবীর, ভালো মানুষ হিসেবে। বেসিক ব্যাংকে এসব এলাকার অনেককে চাকরি দিয়েছেন তিনি।

শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর বিষয়ে স্থানীয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক। 

গ্রামের পশ্চিম পাড়ার কৃষক তরিকুল ইসলাম বলেন, হাই (শেখ আবদুল হাই বাচ্চু) এলাকায় অনেক কিছু করেছেন। মসজিদ-মাদ্রাসা করেছেন, অনেক দান-সদকা করেন। এই এলাকায় সবার উপকারই করেছেন। আমার এক চাচাতো ভাইকে চাকরি দিয়েছেন। এলাকায় এলে আগে তো মানুষের লাইন পড়ে যেত। বড় বড় গাড়ি নিয়ে আসতেন। তবে সম্প্রতি আর আসেননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি হতাশা নিয়ে বলেন, আমার বাড়ি এই পাশেই। তারা বাড়ির সামনে মসজিদ করেছে। আমার বাড়ি থেকেও কাছে। তবে এ মসজিদে আমি যাই না, হেঁটে দূরে ওই মাথার মসজিদে যাই নামাজ পড়তে। আর কিছু বলবো না।

শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর এক প্রতিবেশী বলেন, এসব মামলায় কিছুই হবে না। এখানে স্কুল মাঠে মিটিংয়ে বাচ্চু সাহেব নিজেই বলছেন- ‘আমি যে পরিমাণ সম্পদ করে রেখে যাচ্ছি দুই চার প্রজন্ম খেয়ে শেষ করতে পারবে না।‌’ তবে তেমন জায়গা জমি করেননি গ্রামে। ঢাকায় তাদের অনেক বাড়ি-গাড়ি আছে। বিদেশেও বাড়ি আছে শুনেছি। সবাই জানে ব্যাংক মারা টাকা। কিন্তু নানা কিছু পেয়ে কেউ মুখ খোলে না। কারণ স্থানীয় প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই কাউকে না কাউকে চাকরি দিয়েছেন তিনি। পারিবারিক মসজিদের মুয়াজ্জিনের দুই মেয়ের স্বামীকেও চাকরি দিয়েছেন।  

স্থানীয় আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সর্বশেষ এক বছর আগে গ্রামের এই বাড়িতে এসেছিলেন বাচ্চু। তবে তার ছোট ভাই আসেন প্রায় নিয়মিত। তবে এলাকার অধিকাংশ মানুষই জানেন না বাচ্চুর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা-চার্জশিটের বিষয়ে। তবে টিভি-পত্রিকার মাধ্যমে কেউ কেউ জেনেছেন তাদের অর্থ কেলেঙ্কারির খবর।

বিপুল নামে অপর এক ব্যক্তি বলেন, চুরি করুক আর যাই করুক এলাকার অনেককে চাকরি দিয়েছেন তিনি।‌ চাকরি দেওয়ার জন্য কারো কাছ থেকে টাকা নেননি। স্বাধীনের পর এলাকায় তার বাবার নামে স্কুল হয়েছে। একটা জমিও নিয়েছিলেন কলেজ করবেন বলে। এলাকার উপকারই করেছেন অনেক।

কথা হয় তাদের বাড়িটির কেয়ারটেকার জাবের আলী শেখের সঙ্গে। তিনি বলেন, শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর বাবা পাকিস্তান আমলে পুলিশে চাকরি করতেন। সন্তানদের জন্ম এখানে হলেও তারা দেশের বাইরেই বড় হয়েছেন। 
 
তবে স্থানীয় কোনো জনপ্রতিনিধি বাচ্চুর বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। এলাকাবাসীর দাবি- বর্তমানে রাজনীতিতে সুরাসরি যুক্ত না থাকলেও এরশাদ আমলের সংসদ সদস্য ও বাগেরহাট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ। সেই সূত্রে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মেম্বার মনোনয়ন থেকে নির্বাচনেও প্রভাব রয়েছে তার। এলাকায় এলে নেতারা ভরে যায়। মামলা হোক আর যাই হোক তার কিছুই হবে না।

জাতীয় পার্টি থেকে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাট-১ আসন (চিতলমারী, মোল্লাহাট ও ফকিরহাট) থেকে অংশ নিয়ে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ওই সময় অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ১৯৮৮ সালের ১২ অক্টোবর থেকে ১৯৯০ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত বাগেরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। একই সময় তিনি ছিলেন বাগেরহাট জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি।

আরএআর