প্রায় চার বছরের দীর্ঘ ও জটিল চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে আসে রাবেয়া-রোকাইয়া। তাদের পেয়ে এলাকাজুড়ে উৎসবের আমেজ বয়ে গেছে। বেঁচে থাকা নিয়েই যেখানে ছিল সন্দেহ, সেখানে তারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে, এমন ভাবনা ছিল স্বপ্নাতীত। কারণ, এশিয়া মহাদেশে এই প্রথম কোনো জোড়া মাথা নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সম্পূর্ণ আলাদা করা হয়েছে। এ যেন রূপকথার গল্প। কিন্তু বাস্তবের গল্প ছিল আরও বেশি রোমহর্ষ ও আভিযাত্রিক।

১৩ মার্চ বিকেল পাঁচটায় মাইক্রোবাসযোগে বাড়িতে আসে তারা। এ সময় এলাকাবাসী ও স্বজনদের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হয় তারা। তাদের একনজর দেখতে প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বাড়িতে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। এর আগে ১২ মার্চ দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতাল থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাবেয়া-রোকাইয়াকে বিদায় জানান।

রাবেয়া-রোকাইয়া পাবনার চাটমোহর উপজেলার আটলংকা গ্রামে স্কুলশিক্ষক দম্পতি রফিকুল ইসলাম ও তাসলিমা বেগমের দুই সন্তান। জন্মের পর ক্রেনিয় পেগাজ নামের বিরল রোগে আক্রান্ত হয় রাবেয়া-রোকাইয়া।

সম্প্রতি রাবেয়া-রোকাইয়াদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, রোকাইয়া সম্পূর্ণ সুস্থ না হলেও বিছানার ওপর শুয়ে মনের আনন্দে খেলা করছে। দারুণ উৎফুল্ল ও চঞ্চল সে। অন্যদিকে সম্পূর্ণ সুস্থ রাবেয়া বাবার সঙ্গে হাত ধরে বেড়াচ্ছে, মোটরসাইকেলে চড়ছে। বাড়ির অন্য শিশুদের সঙ্গে বাইসাইকেল নিয়ে খেলাধুলা করছে। বিকেল হলেই খেলার জন্য বের হয়ে যায় ঘর থেকে।

দুই বোনের মধ্যে রোকাইয়া শারীরিকভাবে নিষ্প্রভ থাকলেও, রাবেয়ার মুখে হাসি যেন লেগেই থাকে সর্বদা। তার মুখের হাসিতেই যেন আনন্দ ছড়িয়েছে এলাকার মানুষদের মাঝে।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই পাবনা শহরের পিডিসি হাসপাতালে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেয় রাবেয়া-রোকাইয়া। জন্মের পর থেকে মা-বাবা শিক্ষক দম্পতি রফিকুল ইসলাম ও তাসলিমা খাতুনের ঘরে আনন্দের বন্যা বওয়ার কথা, কিন্তু রাজ্যের দুশ্চিন্তা ভর করে তাদের মনে। কারণ, নবজাতকদ্বয়ের মাথা জোড়া লাগানো। কীভাবে কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না তারা। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রতিবেদন প্রকাশ হতে থাকে। তাতেই খবর পৌঁছায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। তিনি সব জেনে চিকিৎসার দায়িত্ব নেন রাবেয়া-রোকাইয়ার।

২০১৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয় রাবেয়া-রোকাইয়াকে। এখানে দুই স্তরে মস্তিষ্কের রক্তনালিতে অস্ত্রোপচার করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সরকারি খরচে শিশু দুটিকে হাঙ্গেরি পাঠানো হয়। সেখানে হাঙ্গেরিতে সাত মাসে ছোট-বড় ৪৮টি অস্ত্রোপচার করা হয়। হাঙ্গেরি সরকারের মাধ্যমে হাঙ্গেরিয়ান দাতব্য সংস্থা অ্যাকশন ফর ডিফেন্সলেন্স পিপল ফাউন্ডেশন (এডিপিএফ) চিকিৎসায় সক্রিয় সহায়তা করে। সেখান থেকে এনে ঢাকার সিএমএইচে ভর্তি করা হয়।

সিএমএইচ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, ২০১৯ সালের ২২ জুলাই দেশে এনে রাবেয়া-রোকাইয়াকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। ডা. সামন্ত লাল সেনের নেতৃত্বে দেশি-বিদেশি অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে ১ আগস্ট থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত ‘অপারেশন ফ্রিডম’ নামক ৩৩ ঘণ্টাব্যাপী বিরল এই অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। তাদের মাথার খুলি ও ব্রেন আলাদা করে এই চিকিৎসা করা হয়।

এই সফল অস্ত্রোপচারে হাঙ্গেরির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক ইনস্টিটিউট, সিআরপি ও শিশু হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট সার্জন ও চিকিৎসা সহায়তাকারীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি মেডিকেল টিমে প্রায় ১০০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অংশ নেন।

সিএমএইচ কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছিল, এই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পেল। জোড়া মাথা আলাদা করার জটিল অস্ত্রোপচার বাংলাদেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক অনন্য সাফল্য বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই অস্ত্রোপচার বিশ্বের ১৭তম সফল অস্ত্রোপচার। এশিয়া মহাদেশ ও বাংলাদেশে সর্বপ্রথম, যা দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য একটি মাইলফলক।

তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, এ ধরনের অস্ত্রোপচার সারা বিশ্বেই বিরল ঘটনা। উপমহাদেশে এ রকম অস্ত্রোপচার এটিই প্রথম।

রাবেয়া-রোকাইয়ার চাচা সিদ্দিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, যখন তাদের জন্ম হয়, তখন মাথা জোড়া লাগানো ছিল। আমরা বিস্মিত ও হতবাক হই। সবাই বলেছিল মাথা দুটিকে কোনো দিনই আলাদা করা সম্ভব নয়। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি শিশু দুটি পৃথক হয়ে সুস্থভাবে জীবন যাপন করবে।

জোড়া মাথার যমজ শিশু জন্মের পর রাবেয়া-রোকাইয়ার বাবা রফিকুল ইসলামের মনে শান্তি ছিল না। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, অনেকে অনেক রকম কথা বলেছে। কটু কথাও শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমার সন্তানদের জন্য আজ সারা বিশ্বে আমরা পরিচিতি লাভ করেছি। রাবেয়া-রোকাইয়ার বাবা হিসেবে আমি গর্বিত। 

প্রধানমন্ত্রী, চিকিৎসক ও গণমাধ্যমকর্মীদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব না নিলে এত বড় একটি অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা যেত না। সবাই আমার মেয়েদের জন্য দোয়া করবেন, যাতে অন্যদের মতো স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে পারে।

রাবেয়া-রোকাইয়ার মা তাসলিমা খাতুন বলেন, তাদের জন্মের পর হতাশ হয়ে পড়ি। মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। একটাই স্বপ্ন ছিল, রাবেয়া-রোকাইয়াকে সুস্থ জীবনে ফিরে আনা। অবশেষে আল্লাহর রহমতে তা হয়েছে। যদিও কয়েক বছর পরে গ্রামের আলো-বাতাসের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছিল না তারা। হঠাৎ বাড়ি ফেরার প্রথম দিকে জ্বর-ঠান্ডা কাশিতে ভুগছিল কিছুদিন।

অন্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যদি কারও ঘরে জোড়া মাথার যমজ সন্তানের জন্ম হয়, তারা যেন ভয় না পান। আমাদের সঙ্গে সরকার আছে, হাঙ্গেরির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল আছে। এখন আর জোড়া মাথা আলাদা করা কঠিন কিছু নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা, তিনি মায়ের মতো ভূমিকা রেখেছেন। চিকিৎসকদেরও আন্তরিক অভিনন্দন।

দুই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা জানতে চাইলে তাসলিমা বলেন, তারা যেন সুস্থ জীবন যাপন করতে পারে, মানুষের মতো মানুষ হয়ে সমাজের জন্য কাজ করতে পারে। দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে আদর্শ নাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে পারে, সেই আশাই ব্যক্ত করি।

পাবনার জেলা প্রশাসক মো. কবির মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাবেয়া-রোকাইয়ার জোড়া মাথা আলাদা হওয়া দেশের জন্য অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সরকারের জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এরপরও এই জেলায় যদি কারও এমন শিশুর জন্ম হয়, তাহলে সম্পূর্ণ চিকিৎসার খরচ সরকারিভাবে বহন করা হবে।

তিনি আরও বলেন, রাবেয়া-রোকাইয়া বাড়িতে আসার পর থেকেই আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব সময় খোজঁখবর রাখছি। তাদের কোনো সমস্যা হলে দ্রুত তাদের সহযোগিতা করা হবে।

এনএ