দাদার পর বাবা গৌরাঙ্গ সেন করেছেন কামারের কাজ। বাবার কাছ থেকেই ১০ বছর বয়সে বাবুল সেনের হাতেখড়ি। এরপর কেটে গেছে জীবনের ৭০টি বছর। ৭০ বছর ধরে তিনি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঘরিসার বাজারে সরকারি খাস সম্পত্তির ওপর ছোট্ট একটি টং দোকান তুলে তৈরি করছেন গৃহস্থের নিত্যপ্রয়োজনীয় হাতিয়ার।

অভাবের কারণে ছোট্ট বয়সেই বাবার কাজের সহযোগী হিসেবে কামারের কাজ শুরু করেন বাবুল সেন। প্রতিদিন আগুনের তাপ ও লোহার পোড়া গন্ধে এখন অসুস্থ তিনি।

বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত লোকজ সংস্কৃতি বিষয়ক গ্রন্থের তথ্যমতে ২০ বছর আগে শরীয়তপুরে প্রায় পাঁচ হাজার কামার ছিলেন। বছর দশেক আগেও ছিল এক হাজার ২০০ কামার। দিনদিন এ সংখ্যা কমতে কমতে এখন তিন থেকে পাঁচ শ তে এসে নেমেছে বলে দাবি স্থানীয় লোকজ গবেষকদের। হারিয়ে যাওয়া এসব কামারদের মতো বাবুল সেনও হারিয়ে যাবেন। হারিয়ে যাওয়ার আগে শেষ বয়সে নিপুণ হাতে কাজ করছেন বাবুল সেন। কোরবানির ঈদে স্থানীয়দের ছুরি ও চাপাতিসহ পশু জবেহ করার হাতিয়ার তৈরি করছেন। প্রতিদিন প্রায় ১০০ টাকার ওষুধ সেবন করা বাবুল সেনকে আগুন থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। কিন্তু সংসারে অভাবের কারণে এখনও আগুনের তাপে কামারের কাজ করতে হয় তাকে।

বাবুল সেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ২০ বছর আগে দোকান বন্ধ করে সখিপুরের চেয়ারম্যান বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে ডাকাতের হাতে প্রাণ হারান বড় ছেলে মিহির সেন। বাবুল সেনের ইচ্ছে ছিল বড় ছেলেকে একটি দোকান দিয়ে তিনি নিজে অবসরে যাবেন। কিন্তু ছেলে মারা যাওয়ার পর বাবুল সেনের জীবনে সুখ আর দেখা দেয়নি। ছোট ছেলে নিখিল সেন রূপার গহনা তৈরির কাজ করে যে আয় করেন তা দিয়ে সংসারের খরচ হয় না বলে এখনও কামারের কাজ করতে হয় বাবুল সেনকে।

৭০ বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে কাজ করেন বলে বাবুল সেনের কদর একটু বেশি। সারা বছর কাজ না থাকলেও কোরবানি ঈদ উপলক্ষ্যে বাবুল সেনের ব্যস্ততা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। বছরজুড়ে প্রতিদিন বাবুল সেন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করলেও কোরবানি উপলক্ষ্যে এখন তার আয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা।

ঢাকা পোস্টকে বাবুল সেন বলেন, ১০ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে বাজারে এসেছি। সেই থেকেই কাজ শিখেছি। বাবাই আমার ওস্তাদ। এটা আমাদের পাঁচ পুরুষের পেশা। দাদা-বাবা চলে যাওয়ার পর আমিই আগলে রেখেছি এই পেশাকে। বড় ছেলেকে ডাকাত মেরে ফেলায় আমি এখনও এই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি। প্রায় ৮০ বছর বয়স আমার। সংসারে অভাব না থাকলে তো আর কাজ করতাম না। সেই পাকিস্তান আমল থেকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমার নাম-ঠিকানা লিখে নিলেও কেউ কোনো সহযোগিতা করেনি। যদি আধুনিক হাতিয়ার কেনার মতো ঋণ পেতাম এবং পণ্যগুলো বড় বড় বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা থাকত তাহলে কামারেরা হারিয়ে যেত না। এখন হয়ত মিল কারখানায় তৈরি ছুড়ি-কাঁচি থাকবে বাজারে। আদিকাল থেকে কামারের তৈরি নকশার হাতিয়ার থাকলেও কামার থাকবে না। এটা আমাদের জন্য দুঃসংবাদ।

বাবুল সেনের পার্শ্ববর্তী দোকানদার বিজয় দত্ত ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার দোকানে আধুনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে কাজ করি। কিন্তু বাবুল সেন বাজারের সবচেয়ে পুরোনো কামার। তিনি এখনও হাতেই কাজ করেন।

ঘরিসার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রব খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘরিসারে বাবুল সেনের মতো অনেকেই কামারের কাজ করতেন। বাবুল সেন অসুস্থ তা আমি জানতাম না। তাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।

জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্মকতা ডা. সুবোধ কুমার দাস বলেন, পশু জবেহ করার সময় ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি বা কামারের তৈরি ছুরি দিয়ে জবেহ করা ভালো।

লোকজ গবেষক ও কবি শ্যামসুন্দর দেবনাথ ঢাকা পোস্টকে বলেন, কামার পেশা একটি আদি পেশা। এ পেশায় নতুন করে এখন আর কেউ আসতে চায় না। একদিকে তাদের তৈরি পণ্যের চাহিদা কমেছে ইন্ডাস্ট্রির কারণে, অন্যদিকে কাজটি খুবই কষ্টকর। জেলায় ১০ বছর আগে কামার ছিল প্রায় ১ হাজার ২০০। কিন্তু এখন চার থেকে পাঁচশ’র বেশি হবে না। সরকারের উচিত আদি পেশাটি টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা।

সাইফুল ইসলাম সাইফ রুদাদ/এমজেইউ