বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো উদ্ভাবিত হয়েছে মাছের ভ্যাকসিন ‘বায়োফ্লিম’। এই ভ্যাকসিনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মড়ক প্রায় ৮৪ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে আরও গবেষণার মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব।

দেশে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহার উপযোগী মাছের ভ্যাকসিন বায়োফ্লিম উদ্ভাবন করেছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আবদুল্লাহ আল মামুন।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ সূত্রে জানা যায়, গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত বায়োফ্লিম ভ্যাকসিন স্বাদু পানিতে চাষ করা মাছের এরোমোনাস হাইড্রোফিলা নামক ব্যাকটেরিয়াজনিত ক্ষত, যা আলসার, পাখনা ও লেজ পচা রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। শুরুতে পাঙাশ মাছের ওপর এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে ৮৪ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য মাছে প্রয়োগের মাধ্যমেও এর সফলতা পাওয়া গেছে।

জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, চিলিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৮ প্রজাতির মাছে ২৮ ধরনের ভ্যাকসিন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহৃত হলেও বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এই ভ্যাকসিন উদ্ভাবিত হয়েছে। পাঙাশ মাছের ওপর গবেষণা করে ভ্যাকসিনটি উদ্ভাবন করা হলেও এটি স্বাদু পানিতে চাষযোগ্য ইন্ডিয়ান মেজর কার্প যেমন রুই, কাতলা, কই, শিং প্রভৃতি মাছের ক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় মৎস্য স্বাস্থ্য ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আবদুল্লাহ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল এই ভ্যাকসিন। প্রথমে ভারতে এটি নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে এর কার্যকারিতা পেয়েছি। দেশে এই প্রথম এই ভ্যাকসিন পাঁচ মিলিমিটার উৎপাদন করেছি।

পাঙাশ মাছের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনটি শতকরা ৮৪ ভাগ কার্যকরী বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে মাছের ভ্যাকসিন তৈরি করতে প্রয়োজন আধুনিক যন্ত্রপাতির, যা পাওয়া গেলে অচিরেই ভ্যাকসিনটি নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ শেষ করে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা সম্ভব।

ড. মো. আবদুল্লাহ আল মামুন, সহযোগী অধ্যাপক

এই গবেষক বলেন, আমাদের এখানে ভ্যাকসিনটি উৎপাদনের জন্য যেসব আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রয়োজন, তার অভাব রয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি পাওয়া গেলে আরও গবেষণার মাধ্যমে আমরা মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করতে পারব। বর্তমানে আমরা ‘বায়োফ্লিম’ উৎপাদন করেছি খুব কম, যা মাত্র আধা কেজি মাছের খাবারের সঙ্গে মেশানো যাবে। আমরা বিশ্বাস করি, এই ভ্যাকসিন বিভিন্ন মাছে অধিকাংশ মড়ক কমিয়ে আনবে।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. মতিয়ার রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাণিজ্যিকভাবে মাছের ভ্যাকসিন তৈরি করতে প্রয়োজনীয় সব আধুনিক যন্ত্রপাতি খুব দ্রুতই আনা হবে। পাশাপাশি গবেষণাকাজ বাড়াতে অর্থ বরাদ্দও বাড়ানোর জন্য ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, বায়োফ্লিম ভ্যাকসিন আমাদের ল্যাবে তৈরি করতে পারব। প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থপ্রাপ্তির পর আমরা এটি উৎপাদনে যাব। আশা করি এই ভ্যাকসিনের মাধ্যমে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম হবে এবং বাংলাদেশের মাছচাষিরা এই ভ্যাকসিনের সুফল পাবেন।

গবেষণার জন্য অতীতে সরকারি আর্থিক সহযোগিতা কম ছিল কিন্তু বর্তমানে সরকার যথেষ্ট পরিমাণে সহযোগিতা করছে। তার মাধ্যমে আমরা শিক্ষকদের গবেষণার জন্য অর্থ প্রদান করছি। এই গবেষণা আরও সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে, বলেন উপাচার্য।

বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন হয় প্রায় ৪০ লাখ মেট্রিক টন, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাণিজ্যিকভাবে বিশ্বের ৫৫টি দেশে রফতানি করা হয়। তবে মাছের বিভিন্ন রোগের কারণে মড়ক দেখা দেয়। এতে প্রচুর পরিমাণ মাছ মারা যায়। মাছচাষিরা আর্থিকভাবে হন প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত। আর মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম হলেও কার্যকরী ভ্যাকসিনের অভাবে প্রতিবছর বিভিন্ন রোগে প্রচুর পরিমাণ মাছে মড়ক দেখা দেয়। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষিরা অন্যদিকে কমছে মাছের উৎপাদন। ভ্যাকসিনটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা গেলে লাভবান হবে দেশের মাছচাষিরা।

তুহিন আহমদ/এনএ