টানা কয়েক দিনের বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বেড়ে যায় মাদারীপুরে আরিয়াল খাঁ নদের পানি। এতে তলিয়ে যায় অনেক গ্রাম ও ফসলের মাঠ। পরে হঠাৎ আরিয়াল খাঁ নদের পানি নামতে থাকায়, পানির টানে নদী তীরবর্তী এলাকায় বেড়েছে ভাঙন। অনেক জায়গায় মানুষের বাড়ি-ঘর, স্কুলকলেজ, কৃষি জমি ও স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে। 

আরিয়াল খাঁ নদের ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে চরাঞ্চলের মানুষ। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে মাদারীপুর সদর উপজেলার তাল্লুক, মহিষের চর, পাঁচখোলা, কাজিরটেক ফেরিঘাট, বাবনাতলা, ঝাউদি ইউনিয়নের ব্রাহ্মন্দি, হোগলপাতিয়া, চর হোগলপাতিয়া গ্রাম, মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার আলিনগর ইউনিয়নের তিন নদীর মুখ, আনন্দ বাজার, সূর্যমনি, খাসেরহাট, মোল্লার হাট, সীমিতর হাট, ভাটোবালি, আলীপুর, বাঘাবাড়ি, আন্ডারচর, কাচিকাটা গ্রামের পাঁচ শতাধিক বসত বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি ও বসতবাড়ি। ভাঙনকবলিত পরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছে।

সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এই নদী ভাঙন রোধের জন্য গেল বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে আলিনগর এবং ঝাউদি ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থানে দেওয়া হয়েছিল জিও ব্যাগ। স্থানীয়দের দাবি অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালুকাটা ও হঠাৎ নদীর পানি কমে যাওয়ায় নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। এখন অনেকেই তাদের বাড়িঘর ও ফসলি জমি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। 

স্থানীয় বাসিন্দা রহিমা খাতুন (৬৫) অভিযোগ করে বলেন, চার বছর আগে আমার স্বামী মারা গেছে। তখন নদীর মাঝে আমাদের ছোট একটা ঘর ছিল। বর্ষার সময় হঠাৎ নদী ভাঙা শুরু হয়। তখন বাড়িটা সরিয়ে নেই। এরকম সরাতে সরাতে ১০ বার বাড়ি ভাঙছি। নদী ভাঙতে ভাঙতে আমার সব জায়গা জমি কেঁড়ে নিছে। এই নদীর জন্য আমি আমার স্বামীরে হারাইছি। আমার ঘরবাড়ি হারাইছি, সংসার হারাইছি, এখন অন্যের ঘরে থাকি। ভাঙতে ভাঙতে বাড়ির পাশে নদী চলে এসেছে। ভাঙার কথা মনে পড়লে কান্না চলে আসে! আমরা সরকারকে ভোট দিছি, সরকার যদি আমাদের দিকে তাকায়। তাহলে আমরা ঘরবাড়ি করে থাকতে পারবো। আর নাহলে আমাদের আর বাঁচার কোনো জায়গা থাকবে না।

কৃষক গিয়াসউদ্দিন বেপারী বলেন, হঠাৎ নদীর পানি কমে যাওয়ায় আবারো নদী ভাঙতে শুরু করেছে। আর এক হাত নদী ভাঙলেই আমার ঘর ভেঙে যাবে। সরকার ও প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি তারা যেন দ্রুত আমাদের এখানে একটা ব্যবস্থা করে। যাতে নদীভাঙার হাত থেকে রেহাই পাই। 

স্থানীয় ফরিদা বেগম (৭০) বলেন, বিয়ে হওয়ার পর থেকে দেখতেছি নদী ভাঙন। প্রায় তিন থেকে চার একর জমি এই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের একটি বাগান ছিল নদীর পাড়ে। সেই বাগানটিও নদী নিয়ে নিছে। এখন ছোট একটি ঘর উঠিয়ে সন্তানদের নিয়ে আছি। এখন যেভাবে নদী ভাঙা শুরু হয়েছে যদি এভাবে নদী ভাঙে তাহলে ঠাঁই নেওয়ার মতো আর আর কোনো জায়গা নেই। সরকারের কাছে আমাদের কোনো চাওয়া নেই। সরকার যেন আমাদের এই নদী ভাঙাটা বন্ধ করে দেয়।


মাঝি সবুজ হাওলাদার অভিযোগ করে বলেন, এখানে ভালো কোনো নৌকার ঘাট নেই। নদী ভাঙার কারণে আমাদের যে ঘাট ছিলও তাও ভেঙে গেছে, এখন নৌকা ভেড়াতে কয়েক কিলোমিটার অতিরিক্ত পথ পাড়ি দিতে হয়। আগে তিন লিটার তেলে সারাদিন নৌকা চালাতে পারতাম। কিন্তু এখন ৫-৬ লিটার তেল লাগে। নদী ভাঙন বন্ধ হলে আমাদের অনেক উপকার হতো।

স্থানীয় কৃষক আনোয়ার বলেন, আমার দুই একর জমিতে পাট চাষ করছিলাম। দেড় একর জমির পাট নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে আমি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।

হাজারো মানুষের কান্নার কষ্ট রয়েছে এই নদীর জন্য। তারপরও নদী ভাঙন ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাই এই নদীপারের মানুষের দাবি সরকার যেন নদী ভাঙন রোধে তাদের জন্য বাধ তৈরি করে দেন। 

আলীনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহিদ পারভেজ বলেন, নদী ভাঙনের বিষয়টি জানতে পেরেছি। পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে একটা ব্যবস্থা নেবো। যাতে দ্রুত ভাঙন রোধ করা যায়।

মাদারীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সানাউল কাদের খান বলেন, হঠাৎ পানি কমায় নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। আমাদের টিম বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে। যে জায়গাগুলোতে বেশি ভাঙছে সেখানে জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন রোধ করা হবে। ইতোমধ্যে কালকিনি উপজেলার চারটি ভাঙন স্থানে জিওব্যাগ ফেলা হয়েছে। 

রাকিব হাসান/এএএ