পলিতে কমেছে তিস্তার পানি ধারণ ক্ষমতা, ঝুঁকিতে ৩ জেলা
সংস্কারের অভাবে গত ৪০ বছরে মূল প্রবাহ থেকে সাড়ে ৩ কিলোমিটার সরে গেছে তিস্তা। বালু ও পলিতে ভরাট হয়ে কমেছে তিস্তার গভীরতা, ফলে অল্প পানিতেই বন্যা ও ভাঙনের মতো ক্ষতি বাড়ছে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও জমি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন তিস্তা পারের মানুষ। আতঙ্কে কান্না আর হতাশার মধ্যেই এখন দিন কাটছে তাদের।
গবেষণা থেকে জানা গেছে, সব থেকে বেশি ক্ষয় ক্ষতির ঝুঁকিতে তিস্তা তীরবর্তী নীলফামারী, লালমনিরহাট ও রংপুর জেলার মানুষ। নদী আন্দোলনকারীরা বলছেন, তিস্তা পরিচর্যায় দ্রুতই উদ্যোগ নেয়া না হলে বিশাল এক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাবে।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, তিস্তার মূলপ্রবাহ ছিল একটি। কিন্তু বছর দুয়েক আগে ৩ কিলোমিটারের মতো দূরে সরে যায় এ প্রবাহ। এবার যখন পানি বাড়তে শুরু করেছে, তখন আবার তা ফিরে এসেছে পুরোনো চ্যানেলে। আগে থেকে নেয়া এখানকার যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল, সেগুলো ভাসিয়ে নিয়ে তিস্তা এখন ছুটছে ভাটির দিকে।
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ছোটখাতা গ্রামের বাসিন্দা ওমর আলী। ৭ বছরে তিন বার ভাঙতে হয়েছে তার বসতভিটা। প্রথম ভিটা কিনেও পরে ঘর বাঁধতে হয়েছে অন্যের জমিতে। ওমর আলী বলেন, নিজের কেনা বাড়িভিটা নদীতে চলে গেছে, এখন অন্যের জমিতে থাকি। খুব কষ্টে ৫ শতক জমি কিনছিলাম। এখন যে মানুষের জমিতে থাকি এখানেও নদী চলে আসছে ঘরের কাছে। ‘এখন এখানেও আর থাকা যাবে না। কই যাব আল্লাহ মাবুদ জানে। আমি দিন কামাই করি রাইত খাই তারপর কামাই কম। আগে তো নাও নৌকা বানাইতাম কামাই ভালো ছিল।’
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, আবার বাড়ি ভেঙে নতুন করে কোথাও যাওয়ার মতো জায়গা নেই। কোথায় যাবো জানা নেই। সরকার যে ভূমিহীনদের ঘর দিচ্ছে সেটাও পাইনি। টাকা পয়সা না থাকায় মেম্বার চেয়ারম্যানদের কাছে যাই নাই। ভূমিহীনদের নাম নিয়েছিল একবার টাকা দিতে না পারায় আমার নাম দেই নাই।
ওমর আলীর মতো একই অবস্থা ওই এলাকার প্রায় ৫০০ পরিবারের। তিস্তায় চোখের সামনেই সর্বস্ব হারিয়ে কোনোরকম টিকে আছেন তারা। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে তাদের বসতভিটা, আবাদি জমিসহ জীবিকা নির্বাহের সবকিছুই।
ডিমলার খালিশা চাঁপানী ইউনিয়নের কেল্লাপাড়া গ্রামের মকছেদ আলীর (৬০) সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ২০ বছরে ভাঙ্গনের শিকার হয়ে বসতভিটা পরিবর্তন করেছেন বেশ কয়েকবার। ১০ বিঘা আবাদি জমির এখন অবশিষ্ট নেই কিছুই।
মকছেদ আলী বলেন, ‘বাপের দেওয়া যে কয়েক বিঘা আবাদি জমি পাইছিনু। সব শেষ নদীভাঙনত। সব হারায় কোনোমতে জীবন চলিচ্ছে, যা যাওয়ার সব নদীতে চলি গেছে’।
মকছেদ আলীর মতো তিস্তা পাড়ের অনেক বাসিন্দাই জানালেন বছরের পর বছর সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হলেও শুধু ত্রাণ সহায়তা ছাড়া আর কিছুই মিলেনি।
একই এলাকার আমেনা খাতুন বলেন, আমরা ত্রাণ চাই না। নিজে ইনকাম করে আমরা বাঁচতে চাই। এভাবে কাজ করলে তো নদী ভাঙতেই থাকবে। আর ভাঙ্গলে তো বাড়িঘর সরাতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০ বছরে মূল প্রবাহ থেকে ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত সরে গেছে তিস্তা। একই সাথে একাধিক চ্যানেল থাকায় দ্রুত পরিবর্তন আসছে তিস্তায়। বর্তমানে ডানদিকে সরে গেলেও ২০২৪ থেকে থেকে পুনরায় বাম দিকে সরে আসবে এই নদী। একই সাথে পানির ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বাড়বে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি।
প্রতিবছর বন্যা আসলেই অন্যরকম আতঙ্ক ভর করে তিস্তাপাড়ের লাখো বাসিন্দার। দীর্ঘ সময় পরিচর্যা না করায় শুধু ভরাটই হয়নি গতিপথও পরিবর্তন করেছে তিস্তা। গবেষণা বলছে তিস্তা তীরবর্তী ৫ জেলায় বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
তিস্তা নিয়ে আন্দোলনকারীরা বলছেন, নিজস্ব অর্থায়নে হলেও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা না গেলে অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশ, প্রতিবেশসহ হুমকিতে পড়বে জীববৈচিত্র্য।
‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও’ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি জানান, নদীতে তারা ড্রেজিং করে চ্যানেলটা এক করবে, জলাধার নির্মাণ করবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলেছে, পলি অপসারণ, ড্রেজিং, রিজার্ভার নির্মাণ ও সংস্কারে একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে যার ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসফাউদদৌলা বলেন, পলি অপসারণ করে রিজার্ভার নির্মাণের একটা প্রকল্প স্টাডি শেষের পর্যায়ে। এর প্রতিবেদনটা পেলে আমরা ডিপিপি সাবমিট করে এটা অনুমোদন হলে আমরা কাজ করতে পারবো।
বনায়ন কম থাকায় তিস্তা অববাহিকায় সব থেকে বেশি ক্ষতি হচ্ছে নীলফামারী, লালমনিরহাট ও রংপুরে। তাই ক্ষতি কমাতে শুধু তিস্তা সংস্কারই নয় একই সাথে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও বনায়নে গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন নদী গবেষকরা।
শরিফুল ইসলাম/এএএ