৩০ বছর ধরে অন্যের ঘরের চাবি বানান, খোলেনি নিজের ভাগ্যের তালা
চাবি-মিস্ত্রি লতিফ মিয়া
গোপালগঞ্জ শহরের মনোহরীপট্টি রোডের একটি দোকানের সামনে দুই ফুট দৈর্ঘ্য ও দুই ফুট উচ্চতার একটি কাঠের বাক্স। বাক্সের ওপর বিছানো একটি পাটের বস্তা। তার পাশে পাঁচতলা বিশিষ্ট একটি কাঠের তাক। তাকে সাজানো কয়েক প্রকার ডুপ্লিকেট চাবি, কয়েক রকমের পুরোনো তালা, তালা ও চাবির যন্ত্রাংশসহ মেরামতের বিভিন্ন সরঞ্জাম।
এভাবেই দোকান সাজিয়ে কাঠের বাক্সের ওপর বসে আছেন লতিফ মিয়া (৪৬) নামে এক ব্যক্তি। তিনি একজন তালা-চাবির মিস্ত্রি। অন্যের ঘরের হারিয়ে যাওয়া চাবির ডুপ্লিকেট বানান। আবার নষ্ট হয়ে যাওয়া তালা মেরামত ও আলমারি, সিন্দুকসহ বিভিন্ন আসবাবপত্রের তালা খুলে দেন তিনি। এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করে কাটছে তার জীবনের ৩০টি বছর। ৩০ বছর ধরে অন্যের ঘরের তালা খুললেও, খোলেনি নিজের ভাগ্যের তালা।
বিজ্ঞাপন
লতিফ মিয়ার বাড়ি শহরের নতুন বাজার এলাকায়। ১৫ বছর বয়সে বড় ভাইয়ের কাছ থেকে রপ্ত করেছিলেন এই তালা-চাবি মেরামতের কাজ। তখন থেকেই তার একমাত্র পেশা হয়ে দাঁড়ায় তালা-চাবি মেরামত। এই আয় দিয়েই চলে তার সংসার। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি একাই। ৩০ বছর ধরে এই কাজ করে কিছুই করতে পারেননি।
সোমবার (১৭ জুলাই) শহরের মনোহরীপট্টী রোডে তালা চাবি-মিস্ত্রি লতিফের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের। এ সময় তিনি জানান, সপ্তাহে ছয় দিন বসেন এই রোডে। ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে ও তালা মেরামত করে প্রতিদিন তার আয় হয় ২০০-৩০০ টাকা। কোনো কোনো দিন ৫০০ টাকাও আয় হয়। কারো বাসায় গিয়ে কাজ করতে পারলে আয় বেশি হয় তার। এছাড়া একটি তালা মেরামত করলে ৩০ টাকা থেকে ৬০ টাকা ও ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে ৩০-৬০ টাকা মজুরি নেন তিনি। এই সামান্য আয় দিয়ে চার সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে।
বিজ্ঞাপন
এদিকে বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে সব তালা-চাবির ধরন বদলেছে। ফিঙ্গার প্রিন্ট, কি-কার্ডস, কোড সংমিশ্রণ ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সব তালা-চাবি ব্যবহৃত হচ্ছে শহরের প্রতিটি বাড়িতে। তাই তো কদর কমেছে এসব এনালগ তালা-চাবির মিস্ত্রিদের। তার ওপর আবার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সব মিলিয়ে জীবন চালাতে হিমশিম খেতে হয় এ পেশার মানুষদের।
শহরের মনোহরী পট্টির এই রোডে লতিফ মিয়ার মতো আরও ১০ জন তালা-চাবির মিস্ত্রি বসেন। তাদের মধ্যে কেউ ১০ বছর কেউ ২০ বছর কেউ বা ৩০ বছরের মতো এ পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন। তাদের সঙ্গেও কথা বলে জানা যায়- একই অবস্থা তাদের। দীর্ঘদিন ধরে এ পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকায় ছাড়তেও পারছেন না তারা। কিন্তু যা আয় হয় তা দিয়ে বর্তমানে চলাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তারা কেউই তাদের সন্তান অথবা স্বজনদের এই কাজ শেখাতে চান না। কারণ এই পেশার কোনো ভবিষ্যৎ দেখছেন না তারা।
মিলান শেখ (৫০) নামে এক তালা-চাবি মিস্ত্রির সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ২৫ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত আছি। সকাল ১০টায় আসি আর রাত ৮টায় যাই। সপ্তাহে ছয় দিন বসি এখানে। অন্যের তালা মেরামত অথবা ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে সারাদিন সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা আয় করি। কোনো কোনো দিন ১০০ টাকাও আয় হয় না। দীর্ঘদিন ধরে এ পেশার সঙ্গে যুক্ত আছি। অন্য কোনো পেশার কাজও করতে পারবো না। তাই এই সামান্য আয়ে জীবন না চললেও পেশাটা ছাড়তে পারছি না।
বাবুল নামে আরেকজনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, এখন তালার ধরন বদলেছে। সব তালার কাজও আমরা করতে পারি না। এখনকার অনেক মডেলের তালা নষ্ট হয়ে গেলে ফেলে দিতে হয়, মেরামত করা যায় না। আবার অনেক বাড়িতে আধুনিক তালা ব্যবহার করে। তাই আমাদের কদর কমেছে। এ পেশায় এখন আর কোনো ভবিষ্যৎ দেখছি না। তাই এই কাজ সন্তান কিংবা আত্মীয়-স্বজন কাউকে শেখাতে চাই না।
রফিক উল্লাহ নামে আরেকজন তালা-চাবির মিস্ত্রি বলেন, বছরের পর বছর আমরা অন্যের ঘরের তালা চাবি মেরামত করে আসছি। যে আয় হয় তা দিয়ে চলতে অনকে কষ্ট হয়। প্রতিটা দিনই কাটে কষ্টে। পরিবারের লোকজন আমার দিকে চেয়ে বসে থাকে। বাড়ি গেলে এই নেই, সেই নেই। এভাবেই চলছে জীবন। অন্যের তালা অনায়াসে খুলতে পারলেও নিজের ভাগ্যের পথ তালাবদ্ধ। সে তালার চাবি খুঁজি সব সময়।
আরএআর