কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের বড় একটি এলাকায় পাহাড়ি শিশুদের শিক্ষার তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় অকালেই ঝরে যায় সেসব এলাকার পাহাড়ি শিশুরা। সেসব শিশুদের জন্য ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে ‌‘মজুমদার ওয়ান ড্রপ প্রাইমারি স্কুল’। যা ‘জাপানি স্কুল’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে জেলাজুড়ে। 

বাঙালি সংস্কৃতির বলয়ে, বাংলা অক্ষর ও শব্দসহ বাঙালি সিলেবাসে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয় স্কুলটিতে। জাপানি অক্ষর কিংবা শিক্ষাব্যবস্থা কোনোটার তিলও নেই, তবুও স্কুলটি জাপানি স্কুল হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। 

স্কুলটি জাপানি স্কুল হিসেবে পরিচিতির রহস্য হলো, স্কুলটি নির্মাণ করেন মূলত তোশিকো অনিশি নামের একজন জাপানি নাগরিক এবং তার বন্ধুরা। তিনি জাপানের একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। তারিকুল ইসলাম মজুমদার নামের এক বাঙালির সাথে বন্ধুত্ব তার। একবার তিনিসহ বেশ কয়েকজন জাপানি কুমিল্লায় আসেন তারিকুল ইসলাম মজুমদারের আমন্ত্রণে। পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের কথা ভেবে তারিকুল ইসলাম মজুমদারের প্রস্তাবে তোশিকো অনিশিসহ বেশ কয়েকজন জাপানি স্কুলটি নির্মাণ করেন। শুধু স্কুল নির্মাণই নয়। এখানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের শিক্ষার যাবতীয় খরচ, দুপুরের খাবার, বিশুদ্ধ পানি, খেলনার সামগ্রী, শিক্ষকদের বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় খরচ বহন করেন জাপানিজরা। স্কুলটিতে মাসে প্রায় ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ হয় তাদের। আনুষঙ্গিক খরচ জমিদাতা তারিকুল ইসলাম মজুমদার বহন করেন। জাপানিরা প্রতি বছর স্কুলটি পরিদর্শনে আসেন। স্কুলে এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দিনভর খেলাধুলা, আড্ডা দেওয়াসহ সারাদিন সময় কাটান। 

স্কুলটিতে প্রতি শ্রেণিতে ২০ জন করে মোট ১০০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এসব শিক্ষার্থীদের কলম, পেন্সিল, খাতা, স্কুল ড্রেস ও খেলনাসমাগ্রীসহ যাবতীয় খরচ স্কুল কর্তৃপক্ষ বহন করে থাকে। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এসব শিক্ষার্থীদের গরম ভাত বাহারি তরকারি আর মাছ-মাংস দিয়ে খাওয়ানো হয় দুপুরের খাবার। তবে তাদের পাঠ্যবই দেওয়া হয় সরকারিভাবে। বই ছাড়া যাবতীয় সকল শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হয় স্কুল থেকেই। স্কুলটিতে বিনামূল্যেই পড়তে পারেন শিক্ষার্থীদের। 

স্কুলটিতে মোট ৭ জন শিক্ষক রয়েছেন পাঠদানের জন্য। একজন প্রধান শিক্ষক অপর ৬ জন সহকারী শিক্ষক। শিক্ষকদের সবাই নারী। এসব শিক্ষকদের বেতন-ভাতা স্কুল কর্তৃপক্ষই বহন করে থাকে। 

পাহাড়ের বুকে শিক্ষার আলো ছড়ানো স্কুলটি কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার বারোপাড়া ইউনিয়নের বড় ধর্মপুর এলাকায়। কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক চারলেন সড়কের রতনপুর থেকে পশ্চিমদিকে ২ কিলোমিটার পথ। লালমাটির পাহাড়ের বুকে এ যেন এক মনোযোগ আকর্ষণ করা ব্যতিক্রমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ২০১৬ সালে। স্কুলটির চারপাশে সীমানায় সাপ যেন আসতে না পারে সেজন্য তৈরি করা হয়েছে প্লাস্টিকের তৈরি বিশেষ এক প্রাচীর। যা স্কুলের সীমানায় সাপ প্রবেশ রোধ করছে।

মনোরম পরিবেশে, সবুজ পাহাড়ের বুকে ৩ তলা ভবনে গড়া হয় স্কুলটি। প্রতিটি শ্রেণির জন্য আলাদা শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষার্থীদের বসার জন্য বিশেষভাবে তৈরি প্লাস্টিকের বেঞ্চ-টেবিল। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য নজর কাড়া ইউনিফর্ম। তবে ইউনিফর্মটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ছেলেদের জন্য সাদা শার্টের বুকে একটি লাল সূর্য আর সবুজ রঙের ফুলপ্যান্ট। মেয়েদের জন্য সাদা জামা, লাল স্কার্ফ আর সবুজ পাজামা। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইউনিফর্মটিতে জাপান এবং বাংলাদেশের প্রতীক তুলে ধরা হয়েছে। জাপানের পতাকার রং সাদা তার বুকে লাল সূর্য, বাংলাদেশের পতাকা সবুজের বুকে একটি জ্বলন্ত লাল সূর্য। দুটো দেশের সার্বভৌমত্বের পতাকার আদলে ইউনিফর্মটি তৈরি করা হয়েছে।  শিক্ষার্থীদের খাবার রান্নার জন্য দুজন বাবুর্চি রয়েছেন। সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে তারা ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের তরকারি রান্না করে গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করেন শিক্ষার্থীদের। 

সুরাইয়া আক্তার নামের ৫ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবা-মা দুজনেই দিনমজুরের কাজ করেন। এখানে স্কুল না থাকায়, আমার বড় ভাই বোনেরা লেখা পড়ার সুযোগ পায়নি। স্কুল হওয়াতে আমার লেখাপড়া করার সুযোগ হয়েছে।

আবিদ হোসেন নামের ৩য় শ্রেণির এক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ম্যাডামরা আমাদের অনেক আদর করে পড়ান। দুপুরে একবেলা খাবার দেওয়া হয় আমাদের। স্কুলে পড়তে আমাদের এক পয়সাও লাগে না। 

সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, খুব ভালো লাগে ভাবতেই, এসব শিশুরা নিশ্চিত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতো। কিন্তু স্কুলটি এখানে হওয়াতে আশপাশের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষা নিতে পারছে। আমি স্কুলটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এখানে শিক্ষকতা করছি। সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুদের জন্য কিছু করতে পারছি ভেবে ভালো লাগছে।

নাজমা আক্তার নামের আরেক সহকারী শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, কত টাকা পাচ্ছি সেটা বড় কথা নয়, সবচেয়ে বড় কথা হলো অবসর সময়টা এখানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা দিচ্ছি। এটা আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তির।

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক লাভলী আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আমি স্কুলটির প্রধান শিক্ষক। পাহাড়ের বুকে এখানে মানুষ চলাচল করতে ভয় পেতো, সাপ-বিচ্ছুর জন্য। স্কুলটি এখানে হওয়াতে মানুষের পদচারণা বেড়েছে। পাহাড়ি এসব শিশুদের মধ্যে অনেক মেধাবী ছেলে-মেয়ে আছে। স্কুলটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর আমাদের অনেক শিক্ষার্থী ভালো হাইস্কুলে ভর্তি হচ্ছে, এটা আমাদের জন্য গর্বের। তবে শুরুতে কিছুটা বিমুখী থাকলেও দিনে দিনে আগ্রহ বেড়েছে। এখন প্রচুর ছেলে-মেয়ে ভর্তি হতে আসে, কিন্তু জাপানিজরা আসন সংখ্যা সীমিত করে দিয়েছে। প্রতি শ্রেণির জন্য ২০জন শিক্ষার্থী থাকবে। এর বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তি করার অনুমতি নেই, না হলে আরও প্রচুর ছেলে মেয়ে ভর্তি হতো। 

স্কুলটির স্বপ্নদ্রষ্টা তারিকুল ইসলাম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার গল্প শোনালেন। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে তার কিছু জাপানি বন্ধু কুমিল্লায় বেড়াতে আসেন। তাদের মধ্যে তোশিকো অনিশি অন্যতম। কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে ভিক্ষুকদের দেখে তাদের আলাদা দরদ তৈরি হয় এবং তারা সেসব ভিক্ষুকদের দান করতে থাকেন। এবং দানের পরিমাণটা খুবই বড় ছিল। তখন আমার স্ত্রী আমাকে বলে, দ্যাখো তারা (জাপানিরা) এভাবে টাকাগুলো না দিয়ে তাদের দিয়ে স্থায়ী কিছু করানো যায় কি না। তখন আমার মাথায় আসে আমার গ্রামের এলাকাটি পাহাড়ি এলাকা। সেখানে কোনো স্কুল নেই। সেখানকার ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারে না। এখানে একটি স্কুল হলে সবচেয়ে ভালো হয়। আমি আমার প্রস্তাবটি তাদের জানাই। তারা আমাকে কোনো উত্তর জানাননি। তারা জাপান ফিরে যাবার কিছুদিন পর আমাকে জাপান যেতে বলেন। সাথে স্কুল করার যাবতীয় পরিকল্পনা এবং বাজেট ধারণা নিয়ে যেতে বলেন। তখন তিনতলা ভবন নির্মাণের প্ল্যান এবং খরচ নিয়ে জাপান যাই। তারা আমাকে মিটিং করে আলোচনার মাধ্যমে বরাদ্দ দেয়। তারপরই স্কুলটি নির্মাণ করা হয়। 

ভবিষ্যতে স্কুলের পরিসর বৃদ্ধির কথাও জানালেন তারিকুল ইসলাম মজুমদার। তিনি বলেন, এখানে একটি কারিগরি প্রতিষ্ঠান করার জন্য জাপানি বন্ধুদের প্রস্তাব করেছি। সেখানে ৩ বছর মেয়াদের কোর্স থাকবে। প্রতিষ্ঠানটিতে ইংরেজি এবং জাপানি ভাষা শেখানো হবে। পাশাপাশি কর্মমুখী কোর্স থাকবে। এখান থেকে দক্ষ জনশক্তি হয়ে জাপানসহ বাইরের রাষ্ট্রে কাজ করবে আমাদের সন্তানেরা। আমার বন্ধুরা এতে ভালো সাড়া দিয়েছেন। আশা করি, অল্প সময়ের মধ্যে ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের কাজে হাত দিতে পারব।

আরিফ আজগর/এএএ