আতঙ্কে রাতে ঘুম হয় না, এই বুঝি সবকিছু ভেঙে নদীতে চলে গেল
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের জালালপুর গ্রাম। ভাঙতে ভাঙতে যমুনা নদীতে গ্রামটির অর্ধেক বিলীন হয়ে গেছে। এর পাশেই ছিল ঘাটাবাড়ি, কুটিপাড়া, উথলী বাউখোলা ও পাকুরতলা গ্রাম। এই গ্রামগুলোও এখন শুধুই স্মৃতি। এর কোনো অস্তিত্ব আর নেই, চলে গেছে নদীগর্ভে।
এই গ্রামগুলোতে বাস করা মানুষগুলো এখন কে কোথায় আছে তাও কেও বলতে পারে না। কেউবা আবার ধাপে ধাপে বাপ-দাদার বসতভিটা, ফসলি জমি, ঘরবাড়ি সবকিছু হারিয়ে একটু একটু করে পিছাতে পিছাতে এখন ঠাঁই নিয়েছেন জালালপুর গ্রামের নানান পতিত জায়গায়। কেউ মাথার উপরে দু চারটা টিন দিয়ে ছাউনি দিতে পেরেছেন। কেউ আবার পাটের সোলা (পাঠ কাঠি) বা পলিথিন মাথার উপরে দিয়েই কাটিয়ে দিচ্ছেন দিনের পর দিন। সবকিছু হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এই মানুষগুলো।
বিজ্ঞাপন
সবারই অভিযোগ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বিরুদ্ধে। সর্বস্বহারা এই মানুষেরা বলছেন, সঠিক সময়ে কাজ করলে আজ এই ভাঙনের অবস্থা তৈরি হতো না। এমনকি তীব্র ভাঙনের সময়েও ঠিকভাবে কাজ করে না পাউবো। যদি সঠিক সময় বাধটি হতো তাহলে অন্তত চার-পাঁচটি গ্রাম বেঁচে যেত। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের সাড়া না পেয়ে ভাঙন ঠেকানোর জন্যও ফোন করতে হয়েছে স্বয়ং মন্ত্রীকে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলাধীন ব্রাম্মণগ্রাম-হাটপাচিল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় যমুনা নদীর ডানতীর সংরক্ষণ এবং বেতিল স্পার-১ ও এনায়েতপুর স্পার-২ শক্তিশালীকরণ কাজ (মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত প্রকল্প) নামের প্রকল্পটি ২০২১ সালের জুনে অনুমোদন হয়। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৬৪৭ কোটি টাকা। যা ৩০ জুন ২০২৪ এ শেষ হবার কথা রয়েছে। প্রকল্পে ৬টি অঙ্গ আছে। তবে এর কাজ শুরু হয়েছে অনুমোদনের প্রায় একবছর পরে ২০২২ সালের এপ্রিল-মে মাসে।
বিজ্ঞাপন
এর একটি অঙ্গ হলো ব্রাক্ষ্মণগ্রাম থেকে হাটপাচিল সাড়ে ৬ কিলোমিটার নদী তীর সংরক্ষণ কাজ। এটার প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪৭০ কোটি টাকা। মাদার ৬টি প্রকল্পের একটা অঙ্গ এটি।
আরও জানা যায়, ৬৪৭ কোটি টাকার প্রকল্পের বিপরীতে সরকার এখন পর্যন্ত বরাদ্দ দিয়েছে মাত্র ১৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বরাদ্দ দিয়েছে মাত্র ৭৮ কোটি টাকা। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে এসে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আরও ৬০ কোটি টাকা। প্রকল্পটির এখনো দৃশ্যমান কোনো কাজ হয়নি। এখন পর্যন্ত ব্লক বানানো, জিও ব্যাগ ডাম্পিং ও প্লেসিং এর কাজ চলছে। দেশের ১৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে এই প্রকল্পে। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিস্তারিত পাওয়া যায়নি।
সরজমিনে জালালপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, যমুনার ভয়াল ভাঙনের তীব্র ছাপ রয়ে গেছে গ্রামটির নদীর তীরে। কয়েকদিন আগেও তীব্র ভাঙন ছিল এলাকাটিতে। এখন পানি কমতে থাকায় সেটিও নেই। পানি বাড়া শুরু হলেই আবারও ভাঙন শুরু হবে বলে ধারণা করছেন এলাকাবাসী। যমুনা যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে নিতে পারে, তাই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ঘরগুলো। এর পাশ দিয়েই আবার অস্থায়ী ঘর বানিয়েছেন অনেকেই। এদের বেশিরভাগেরই বাড়িঘর চলে গেছে যমুনায়।
ঝুপড়ি ঘরগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, একটি ছোট্ট ঘরে বসবাস করছেন একটি পরিবারের চার থেকে ছয়জন সদস্য। যে পরিবারগুলো আরেকটু বড় তারা বানিয়েছেন একাধিক ঘর। কেউ মাথার উপরে দিতে পেরেছেন টিন কেউবা পলিথিন দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছেন। কেউবা আবার ঘর তোলার কোনো জায়গা না পেয়ে স্তুপ করে রাখা বালুর উপড়ে কোনরকমে বসবাস করছেন। তীব্র রোদে উত্তপ্ত হয়ে যাওয়া বালুর উপরে তাদের জীবন চলছে।
এই পরিবারগুলোর শুধু থাকারই নয় তাদের খাবার কষ্ট রয়েছে। তাদের কাছে নেই তেমন কোনো কর্মও। কেউবা আশেপাশে দিনমজুরের কাজ করেন, কেউ করেন নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়া গাছগুলো তোলার কাজ। সেগুলো বিক্রি করে আবার চলে তাদের জীবিকা। যমুনায় সবকিছু হারানোর কষ্ট যেন তাদের চোখে মুখে ছাপ একে গেছে।
নদীগর্ভে চলে যাওয়া কুটিপাড়া গ্রামের ইসমাইল হোসেনের ছেলে স্বপন। অটো চালিয়ে আর নদীতে মাছ মেরে এখন সংসার চালান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিন বছর আগে যমুনায় বাড়ি-ঘর ভেঙে চলে গেছে। তারপরে যেখানে এসেছিলাম, সেটাও ভেঙে গেছে রোজার আগে। পরিবারের ১৩ জন সদস্য এখন কে যে কোথায় আছে এটাও বলার মতো না। তবুও এখনো যদি ভাঙন বন্ধ করা যেত তাহলেও বেঁচে যেত অনেকে।
স্থানীয় আমদ আলী মোল্লা বলেন, জালালপুর ইউনিয়নের দুই ও তিন নম্বর ওয়ার্ড ইতোমধ্যেই যমুনায় ভেঙে বিলীন হয়ে গেছে। এখন ১নং ওয়ার্ড জালালপুর ভাঙনের মুখে। আমার বাড়ির অর্ধেক ভেঙে গেছে অর্ধেক আছে। আমার বাড়িসহ এই গ্রামটাও যে কখন ভেঙে যাবে এটাও বলা যায় না। দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই যেন আমরা একটা আতঙ্কে থাকি। রাতে ঘুম হয় না, এই বুঝি সবকিছু ভেঙে নদীতে চলে যায়।
আব্দুস সালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই কয়েক বছরে সব হারিয়েছি। আমরা এলাকাবাসী অনেক মানববন্ধন করে, অনেক দাবি করে একটা বাঁধের অনুমোদন পেলাম। ৬৪৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরা বাঁধটি এনায়েতপুরের ব্রাহ্মণ গ্রাম থেকে হাট পাচিল পর্যন্ত হওয়ার কথা। সেটার কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের চরম গাফিলতি ও তদারকি না করার কারণে আজ আমাদের কয়েকটি গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। বাঁধটি সঠিক সময়ে হলে গ্রামগুলো ভেঙে যেত না। আর আজ জালালপুর গ্রামেও এমন ভাঙন দেখা যেত না।
তিনি বলেন, আমাদের জেলা প্রশাসক মহোদয় কিছু পরিমাণ টিন ও টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যাদের কয়েক বছর আগে ভেঙেছে তাদেরকেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নতুন করে যাদের ভেঙেছে, যারা খোলা আকাশের নিচে আছে তাদের কোন বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
মাথার উপরে পলিথিন আর পাটের চট দিয়ে ছাউনি বানিয়ে, তিন পাশে প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে বেড়া দিয়ে ৫-৬ বছর হলো বসবাস করছেন মৃত আব্দুস সালামের স্ত্রী মোছা. আছিয়া খাতুন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এভাবেই এত কষ্টে সন্তানদের নিয়ে পাঁচ ছয় বছর হলো বসবাস করছি। কেউ খোঁজও নেয় না। এখন এই ঘরও যেকোন মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে, এই ভেবে যেন এখন আর ঘুমও আসে না। এক বেলা খেয়ে আর দুবেলা না খেয়ে দিন কাটাই। এগুলোও যেন দেখার কেউ নাই। মাথার ওপরে ছাউনি দিতে চারটি টিনের জন্য এত জায়গায় ঘুড়েছি, তবুও পাইনি।
জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদের ১, ২ ও ৩নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য মোছা. লাইলী বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভাঙন কবলিত মানুষগুলোর কষ্ট দেখলে নিজেরই খুব কষ্ট লাগে কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারি না। আমাদের কাছে তেমন কোনো অনুদানও আসে না। যেটুকু আসে সেটুকুও চেয়ারম্যান একাই আত্মসাৎ করে নেয়।
এ ব্যাপারে জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদের বক্তব্যের জন্য জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে তিনি মোবাইল ফোনে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভাঙ্গন কবলিত মানুষগুলোর সার্বিক বিষয়ে ইউএনও স্যারকে জানানো হয়েছে। এছাড়া যে ১০ বান্ডিল টিন ও কিছু অনুদান এসেছিল সেগুলো ভুক্তভোগীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।
শাহজাদপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া আফরিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসলে আমাদের অনুদানই খুব কম। তারপরও ওই এলাকাসহ ৩টি ইউনিয়নে কিছু টিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ও বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি আজ তাদের জন্য চাল বরাদ্দ দেওয়া হল। এ ছাড়াও আমি ওই এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখবো কেমন কি দরকার। সেই অনুযায়ী আবার ডিসি (জেলা প্রশাসক) স্যারের কাছে চাহিদা দেওয়া হবে। পাশাপাশি চেয়ারম্যানের বিষয়টিও খতিয়ে দেখবো।
জালালপুর এলাকার দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মিলটন হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে ঐ এলাকায় নিয়মিত জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। এছাড়াও বিস্তারিত জানার জন্য আপনি নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলুন।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা যেকোনো বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত আছি। ইতিমধ্যে আমরা ৯টি উপজেলায় ১ হাজার বান্ডিল ঢেউটিন মজুদ রেখেছি। সেখান থেকে বরাদ্দও দেওয়া হচ্ছে। শাহজাদপুর উপজেলায় ৫০ বান্ডিল টিন ও ৬০ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। যদি আরও প্রয়োজন হয় তাহলে ওই উপোজেলার ইউএনও এর মাধ্যমে ডিসির কাছে চাহিদা আসলে বরাদ্দ দেওয়া হবে। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত খাবার রয়েছে। আমি ওই এলাকার মানুষের খোঁজ নিয়ে দরকার হলে তাদের জন্য আরও খাবার চাল বরাদ্দ দেওয়া হবে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি বর্ষা মৌসুমে সিরাজগঞ্জের কয়েকটি উপজেলায় যমুনা নদীতে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এবং ভাঙন রোধে জরুরি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে জিও ব্যাগ ডাম্পিং অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া শাহজাদপুরে আমাদের একটি প্রকল্প অব্যাহত রয়েছে যেটি জুন ২০২৪-এ শেষ হবে। এ প্রকল্পে সাড়ে ছয় কিলোমিটার তীর সংরক্ষণ কাজ রয়েছে। যেটি এনায়েতপুর স্পার থেকে হাট পাঁচিল পর্যন্ত বিস্তৃত। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার পরে অত্র এলাকার ভাঙন পুরোদমে রোধ করা যাবে। এবং আশা করছি সঠিক সময়ের মধ্যেই প্রকল্পটি শেষ করতে পারব।
সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক মীর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিরাজগঞ্জ নদীর ভাঙন কবলিত এলাকা। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ভাঙছে, মানুষ গৃহহারা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর একটা প্রকল্প আছে, আশ্রয়ণ প্রকল্প। ফলে যারা গৃহহীন হচ্ছে তাদের পর্যায়ক্রমে আমরা বিভিন্নভাবে আশ্রয়ণ প্রকল্পে পুনর্বাসন করছি। যখন যারা ভাঙনের শিকার হচ্ছে তাদেরকে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ত্রাণ সামগ্রী দিচ্ছি যেন তাদের জীবন থেমে না যায়। এছাড়া যাদের ঘর-বাড়ি ভেঙে যাচ্ছে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাদেরকে আমরা ঢেউটিন বরাদ্দ দিচ্ছি। যেন তাৎক্ষণিকভাবে তারা বাসস্থান তৈরি করতে পারে। তাদের জন্য আরও কিছু ঢেউটিনের চাহিদা দিয়ে আমরা বরাদ্দ চেয়েছি।
স্থানীয়দের অভিযোগ বাঁধ নির্মাণে ধীরগতি চলছে এমন প্রশ্নের উত্তরে জেলা প্রশাসক বলেন, আসলে বর্ষার মৌসুমে বাঁধ নির্মাণের কাজ সেভাবে এগোয় না। পানির কারণে কাজ করা যায় না। বর্ষা মৌসুমে সাধারণত জিও ব্যাগ ডাম্পিং থেকে শুরু করে প্রয়োজনের তাগিদে সিসি ব্লক পর্যন্ত ফেলা হয়। তবে বন্যা চলে গেলেই বাঁধ নির্মাণের কাজ আরও জোরালোভাবে শুরু হবে বলে আশা করছি।
আরকে