ইতিহাস ও ঐতিহ্যের তীর্থভূমি নাটোর। এ জেলায় রয়েছে বেশ কিছু আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক স্থান। এর মধ্যে উত্তরা গণভবন, নাটোর রাজবাড়ী, হালতিবিল, গ্রিন ভ্যালি পার্ক, শহীদ সাগর, চলনবিল জাদুঘর, চলনবিল, দয়ারামপুর রাজবাড়ী ও লুর্দের রানী মা মারিয়া ধর্মপল্লী। এগুলো পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ জেলাকে নিয়ে ঢাকা পোস্টের বিশেষ আয়োজন।

উত্তরা গণভবন
নাটোর শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে এক মনোরম পরিবেশে ইতিহাসখ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী তথা উত্তরা গণভবন অবস্থিত। নাটোরের রানী ভবানী তার নায়েব দয়ারামের ওপরে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে দিঘাপতিয়া পরগনা উপহার দেন।

১৯৪৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করার পর ১৯৫২ সালে দিঘাপতিয়ার শেষরাজা প্রতিভানাথ রায় সপরিবার রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান। পরে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজপ্রাসাদটি পরিত্যক্ত থাকে।

১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সরকারি ভবন হিসেবে সংস্কার করা হয়। ১৯৭২ সালে এটিকে উত্তরা গণভবন হিসেবে অভিহিত করা হয়। চারদিকে মনোরম লেক, সুউচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত ছোট-বড় ১২টি কারুকার্যখচিত ও দৃষ্টিনন্দন ভবন নিয়ে উত্তরা গণভবন ৪১ দশমিক ৫১ একর জমির ওপর অবস্থিত। ভেতরে রয়েছে ইতালি থেকে সংগৃহীত মনোরম ভাস্কর্যে সজ্জিত বাগান, যেখানে রয়েছে বিরল প্রজাতির নানা উদ্ভিদ।

দয়ারাম রায় এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ১৬৮০ সালে নাটোরের প্রখ্যাত কলম গ্রামের এক তিলি পরিবারে দয়ারাম রায় জন্মগ্রহণ করেন।

নাটোর রাজবাড়ী
রাজশাহী থেকে প্রায় ৪৮ কিমি পূর্বে নাটোর জেলা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নাটোররাজদের বাসভবন। আঠারো শতকের প্রথম দিকে এটি নির্মিত হয়। নাটোর রাজবাড়ীতে প্রবেশের জন্য রয়েছে দীর্ঘ পথ, যার দুপাশে অত্যন্ত যত্নে গড়ে তোলা বোতল পামের সারি বিদ্যমান। এর প্রতিষ্ঠাতা রামজীবন নাটোরেই স্থাপন করেছিলেন তার প্রশাসনিক কেন্দ্র। সেই সঙ্গে নির্মাণ করেছিলেন রাজপ্রাসাদ, দীঘি, মন্দির এবং ফল ও ফুলের বাগান।

প্রায় ৩৭ দশমিক ২০ একর জমির ওপর নির্মিত বর্তমান প্রাসাদ কমপ্লেক্সটি দুটি প্রতিরক্ষা পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। পরবর্তীকালে রানী ভবানী কমপেক্সটির উন্নয়নে ও বৃদ্ধিতে যথেষ্ট অবদান রাখেন।

সাতটি ব্লকের মধ্যে মাত্র চারটিকে মোটামুটি সংস্কার করে বর্তমানে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর বাকিগুলো আকারহীন বিচ্ছিন্ন কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ। একতলাবিশিষ্ট উত্তর ব্লকটি বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে ডেপুটি কমিশনারের অফিস হিসেবে।

হালতিবিল
হালতির বিল বা হালতি বিল নাটোর সদর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে নলডাঙ্গা থানার অন্তর্গত বিল। এটি এই অঞ্চলের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে এখানে পাটুল থেকে খাজুরা পর্যন্ত যে রাস্তা আছে, সেটাই বেশি আকর্ষণীয়। বর্ষায় যখন পানিতে পরিপূর্ণ হতে থাকে বিল, তখন এই রাস্তার সৌন্দর্য বাড়তে থাকে। পর্যটকের ভিড় তখন বাড়তে থাকে। বিলের ভেতরে দ্বীপের মতো যে ছোট ছোট গ্রাম আছে, সেগুলো আরও মনোমুগ্ধকর।

হালতিবিল উত্তরাঞ্চলের মানুষের সমুদ্রের অভাব অনেকটাই পূরণ করছে। হালতিবিলের উত্তাল জলরাশি আর ঢেউ যে কারও মনকে নিমেষেই কোমল করে দেয়। বর্ষায় অথই পানি আর শীতে ফসলি জমির এই বিলের মাঝবরাবর সাত কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক নির্মাণ করা হয় ২০০৪ সালে। পর্যটন আকর্ষণ পর্যটনশিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে অনেক দোকানপাট, হোটেল ইত্যাদি। এই বিলে প্রতিদিন হাজারো মানুষ আসছেন সমুদ্রের স্বাদ নিতে। 

যেভাবে যাবেন হালতিবিলে
নাটোর শহরের মাদ্রাসা মোড় থেকে জনপ্রতি ৩০ টাকা করে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে যাওয়া যায়। তবে অটো রিজার্ভ করে গেলে ভাড়া ২০০ টাকা।

লুর্দের রানী মা মারিয়া ধর্মপল্লী
লুর্দের রানী মা মারিয়া ধর্মপল্লী তথা বনপাড়া ক্যাথলিক মিশন। খ্রিষ্টধর্ম পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে বলা হয় খ্রিষ্টমণ্ডলী বা সংক্ষিপ্তাকারে শুধু মণ্ডলী। কর্তৃপক্ষের মূল পরিচালনা কেন্দ্র ভাটিকান বা রোম। স্থানীয়ভাবে খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী জনসাধারণকে পরিচালনা ও আধ্যাত্মিক পরিচর্যা করা/সেবাদানের উদ্দেশ্যে গঠিত ও পরিচালিত একটি সাংগঠনিক কর্ম এলাকাকে ধর্মপল্লী বলা হয়।

নাটোর জেলার দক্ষিণ সীমানায় বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া পৌরসভার পাঁচটি ও ১ নম্বর জোয়াড়ি ও ৫ নম্বর মাঝগ্রাম ইউনিয়নের দুটিসহ সাতটি গ্রাম নিয়ে এই ধর্মপল্লী প্রতিষ্ঠিত। ঐতিহ্যবাহী বড়াল নদীর দক্ষিণে বনপাড়া নামক একটি গ্রামে ধর্মপল্লীর জন্য নির্ধারিত গির্জাটি অবস্থিত। যেখানে ১৯৪০ সালের দিকে স্বর্গীয় ফাদার থমাস কাত্তানের (পিমে), একজন ইতালীয় ধর্মযাজক সর্বপ্রথম আসেন এবং ছবিতে দেওয়া গির্জাঘরটি স্থাপিত হয় ১৯৫৮ সালে।

ধর্মপল্লী বা গির্জা প্রশাসনের অধীনে একটি হাইস্কুল (সেন্ট যোসেফ উচ্চবিদ্যালয়) ও দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় (সেন্ট যোসেফ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সেন্ট জেভিয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়) পরিচালিত হয়। এ ছাড়া প্রায় ৪৫০ দরিন্দ্র আদিবাসী ছাত্রছাত্রীর অবস্থানের জন্য পৃথক ছাত্র ও ছাত্রীনিবাস পরিচালিত হয়। এলাকার হাজার হাজার দরিদ্র নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য একটি সেলাই কেন্দ্র পরিচালিত হয়। এ ছাড়া এলাকার প্রসূতি মায়েদের সেবাদানের জন্য ১৯৬০-এর দশকে এখানে স্থাপিত হয় দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র, যা এলাকার হাজার হাজার প্রসূতি মাকে নিরাপদ মাতৃত্বে সহায়তা প্রদান করেছে।

শহীদ সাগর
১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ নাটোরের লালপুর উপজেলার গোপালপুরের চার কিলোমিটার উত্তরে ময়না গ্রামে খানসেনাদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরের দিন পাকিস্তানি সেনাদের মেজর রাজা খান চুপিসারে পালানোর সময় স্থানীয় জনগণ তাকে গুলি করে হত্যা করে। এ ছাড়া ঈশ্বরদী বিমানবন্দরে যেন পাকিস্তানি সেনা অবতরণ করতে না পারে, সে জন্য স্থানীয় মুক্তিকামী জনগণ মিলের বুলডোজারসহ অন্যান্য যানবাহনের সহায়তায় বিমানবন্দরের রানওয়ে ভেঙে অকেজো করে দেন।

চলনবিল
চলনবিলের সবচেয়ে বড় অংশ পড়েছে নাটোরে। জেলার সিংড়া উপজেলায় রয়েছে চলনবিলের বড় একটি অংশ। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে বনপাড়া পর্যন্ত দীর্ঘ সড়ক তৈরি হয়েছে চলনবিলের বুকেই। সড়কের দুপাশে এ সময়ে যেদিকে চোখ যায়, শুধু অথই জলরাশি। এ পথে চলতে চলতে সড়কের দুপাশে চলনবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় দুচোখ ভরে। নিজস্ব গাড়িতে গেলে ইচ্ছামতো থেমে এর সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব।

এ ছাড়া চলনবিলের আকর্ষণীয় একটি বিল ‘হাইতিবিল’। এটি নলডাঙ্গা উপজেলায়। জেলা শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে এ বিলের অবস্থান। হাইতিকে দেশের সবচেয়ে গভীর বিল বলা হয়। প্রায় ১২ মিটার গভীর এই বিলে সারা বছরই পানি থাকে।

চলনবিল জাদুঘর
দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিলের মধ্যাস্থলে গুরুদাসপুর উপজেলার নাটোর জেলার খুবজীপুর গ্রামে এ জাদুঘরটির অবস্থান। জ্ঞানপিপাসু অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদ ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর এটি প্রতিষ্ঠা করেন। জাদুঘরটি উপজেলা সদর থেকে আনুমানিক পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

চলনবিল অঞ্চলের প্রাচীন কীর্তি সম্পর্কে গবেষণা করে লুপ্ত ইতিহাস উদ্ধার, প্রাচীন ঐতিহাসিক ও কৃষ্টিগত নিদর্শন, প্রত্নরাজা, শিলালিপি, টেরাকোটা ও মাছ, ঝিনুক, শামুক ইত্যাদি নমুনা সংরক্ষণসহ অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনার অভিপ্রায়ে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত।

১৯৮১ সালে সরকারিভাবে এ জাদুঘরের জন্য পাঁচ কাঠা জমি দেওয়া হয়। ৮৪-৮৫ সালে নরওয়ের দাতা সংস্থা নোরিড ও ৮৫-৮৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থ সাহায্যে গড়ে তোলা হয় জাদুঘর ভবন। ১৯৯০ সালে ১৫ মার্চ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিদফতরের অধীনে রেজিস্ট্রি হওয়ার আগে এটি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় (স্থানীয় ব্যবস্থাপনায়) চলত।

গ্রিন ভ্যালি পার্ক
বনলতা সেন, রানী ভবানী, উত্তরা গণভবন, চলনবিল, মিনি কক্সবাজার পাটুল আর কাঁচাগোল্লার জন্য আগে থেকেই দেশবাসীর কাছে বিখ্যাত হয়ে আছে নাটোর। এবার নাটোরকে আরও এক ধাপ রাঙিয়ে তুলতে দেশের বিপুলসংখ্যক বিনোদনপ্রেমী ও দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে নাটোরের লালপুরে তৈরি হয়েছে ‘গ্রিন ভ্যালি পার্ক’। পার্কটিতে বিনোদনের জন্য রয়েছে স্পিডবোট, প্যাডেল বোট, বুলেট ট্রেন, মিনি ট্রেন, নাগরদোলা, পাইরেট শিপ, ম্যারিগোরাউন্ড, হানি সুইং ইত্যাদি।
এ ছাড়া প্রায় ৩০ একর জমির ওপর বিস্তৃত নয়নাভিরাম লেক, অত্যন্ত মনোরম পরিবেশ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা।

শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটু সুন্দর সময় কাটানোর জন্য ঘুরে আসতে পারেন এ পার্ক থেকে। বাহারি ফুলের সুবাসী মনমাতানো গন্ধ, আঁকাবাঁকা নয়নাভিরাম লেকের বাহার আর পানিপথের রাজা অর্থাৎ দুরন্ত গতির স্পিডবোটে ঘুরে আপনার মন সতেজ হবেই। দর্শনার্থীরা নির্দিষ্ট প্রবেশ মূল্য দিয়ে (৫০ টাকা) পার্কে যেতে পারবেন। এ ছাড়া গাড়ি পার্কিংয়ের জন্যও রয়েছে সুব্যবস্থা।

প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে পার্কটি। তবে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে এই সময় পরিবর্তন হয়।

যেভাবে যাবেন
দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে মাইক্রোবাস, বাস ও মোটরসাইকেলে সহজেই যেতে পারেন লালপুর। এ ছাড়া রেলপথে আব্দুলপুর রেলওয়ে জংশনে নেমে মাত্র ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে এলেই দেখা মিলবে পার্কটির। লালপুর সদর থেকে পার্কটির দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার।

এনএ