রাজশাহীতে ছড়িয়ে পড়েছে গরুর লাম্পি স্কিন রোগ। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে গরু। এই রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। তবে দিনদিন বেড়েই চলছে এ রোগে আক্রান্ত গরুর সংখ্যা। আর গরুর এই রোগে দিশেহারা হয়ে পড়েছে চর খিদিরপুরের বাসিন্দারা। যাদের জীবনের একমাত্র সঞ্চয় এই গরু।

রাজশাহীর পবা উপজেলার চরখিদিরপুরে প্রায় ৬০ পরিবারের বসবাস। বেশিরভাগ পরিবারের জীবন-জীবিকা চলে গরু লালনপালন করে। তাই গরুর এমন রোগে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তাদের। যদিও এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে বেশিরভাগ বাছুর গরু। তবে কয়েকদিন থেকে বড় গরুও আক্রান্ত হচ্ছে। রোগে ছোট বাছুরের মৃত্যু হলে গরুর মালিকের কমপক্ষে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা লোকসান হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন গ্রাম্য পশু চিকিৎসক বলেন, গত বছরের চেয়ে এবছর এই রোগ বেশি ছড়িয়েছে। পদ্মার চর ছাড়াও নগরীর বুধপাড়া, পবার মোহনপুর, পাড়িলা ইউনিয়নের কুয়ারসহ বিভিন্ন এলাকায় এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি দাবি করেন, তিনি বেশ কয়েকটি গরুর চিকিৎসা দিচ্ছেন। তবে চিকিৎসায় সুস্থ হতে সময় লাগবে।

এ বিষয়ে পবা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সুভ্রত কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, গরুর লাম্পি স্কিন রোগ। এটা ভাইরাস জনিত রোগ। তবে এই উপজেলায় কম। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু এলাকায় রোগ দেখা দিয়েছে। চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন এলাকায় ভ্যাকসিন করেছি। কোন কোন এলাকায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, খাতা দেখতে হবে। না হলে বলা যাচ্ছে না। তবে সব এলাকায় ভ্যাকসিন করা হয়েছে।

চর খিদিরপুরের বাসিন্দা আমির আলী (২৫)। তার ছোট-বড় মিলে ৩৫টি গরু রয়েছে। পাঁচদিন আগে আমির আলীর একটি গরুর বাচ্চা মারা যায় লাম্পি স্কিন রোগে। তার দাবি লাম্পি স্কিন রোগের যে লক্ষণগুলো ছিল তার সবই মৃত গরুর ছিল। এছাড়া চিকিৎসা দিতে আসা চিকিৎসকও বলেছেন একই কথা।

আমির আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গরুর বাচ্চা ১০ দিন অসুস্থ পড়ে ছিল। পরে ডাক্তার এসে ইনজেকশন দেন। ইনজেকশন দেওয়ার খানিক পরে বাছুরটি মারা যায়। গরুটির পেছনে চিকিৎসা করতে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ডাক্তার আসলেই ৫শ থেকে ১ হাজার টাকা দিতে হয়। টাকা দিয়েও গরুগুলোকে বাঁচানো যাচ্ছে না। 

আমির আলী আরও বলেন, ওষুধে কোনো উন্নতি হচ্ছে না। প্রত্যেকদিন ডাক্তার এসে দুইটা করে ভ্যাকসিন দিচ্ছে। এই চরে অনেক গরু আছে। প্রত্যেকের ঘরে ঘরে এই অসুখ হয়েছে। কোনো গরু ভালো হচ্ছে না। যারা চিকিৎসা দিয়েছে তারা সরকারি ডাক্তার না। আমরা টাকা দিয়ে নিয়ে এসেছি।

মৃত গরুর কবর দেখিয়ে আমির আলী বলেন, আমার গরুর বাছুর এই ঘরে থাকতো। এখানে মারা গেছে। এখানেই কবর দিয়েছি। আমরা নদীতে ফেলিনা। গরু মারা গেল আমরা গোয়ালে করব দেয়। গোয়ালে গরু যেখানে শুয়ে থাকে সেখানেই কবর দেয়। এটা আমাদের পূর্ব পুরুষদের রীতি।

রোববার (৩০ জুলাই) সকালে একই রোগে মারা গেছে খিদিরপুরের বাসিন্দা আলম হোসেনের গরু। গতকাল দুপুরের দিকে খুবই অসুস্থ ছিল এই গরুটি। আলম হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এলোপতি, হোমিও ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। ওষুধ খাওয়ানোর পরে গরুর পা আরও ফুলে যায়। যতই ওষুধ খাওয়ায় রোগ ভালো হয় না। বরং বেড়ে যায়। কয়েকদিন আগে উঠে চলাফেরা করলো। কাল থেকে আর উঠতে পারছে না। তবে শরীর ফোলা কমেছে। পশুর হাসপাতাল থেকে লেখে দেওয়া ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। সবমিলে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু বাঁচানো যায়নি গরুটাকে।’

পাশে দাঁড়িয়ে গরুর অসুস্থতার কথাগুলো বলছিলেন মরিয়াম বেগম। ছয়মাস আগে স্বামী মারা যাওয়ার পরে একমাত্র সম্বল তিনটি গরু। এরমধ্যে একটি গরু আক্রান্ত হয়েছে লাম্পি স্কিন রোগে। এমন অবস্থায় দিশেহারা ৫০ বছরের এই নারী। তিনি বলেন, স্বামী কাজ করে গরু কিনেছিল। গরুটির বাছুর হয়েছে। কিন্তু সাত দিন থেকে অসুস্থ। গরুর পা ফুলে গেছে। খাওয়া দাওয়া করছে না। বাচঁবে কিনা জানি না।

খিদিরপুর চরে ৬০ থেকে ৬৫টি গরুর মালিক মো. সাইদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত সাত থেকে আট দিন আমার তিনটা গরুর এই অসুখ হয়েছে। ওষুধ খাওয়ালেও ভালো হচ্ছে না। চিকিৎসা করা হয়েছে। তবুও কমেনি। গরুকে ইনজেকশন দিয়েছে, ওষুধ দিয়েছে। খাওয়ানো হয়েছে, কিন্তু অসুখ কমেনি। গরু খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। গরুর মায়ের দুধ দহন করে বোতলের মাধ্যমে খাওয়াচ্ছি। কিন্তু খাচ্ছে না।

রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গোদাগাড়ীর চরে ভ্যাকসিন করা হচ্ছে। এই চরে বাদলা ও এইচএস রোগের (গলা ফোলা) ভ্যাকসিন করা হয়েছে। দ্রুতই চর খিদিরপুরে লাম্পি স্কিন রোগের ভ্যাকসিন ক্যাম্প করা হবে।

শাহিনুল আশিক/এএএ