প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রংপুর আগমনকে ঘিরে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জোরালোভাবে উঠে এসেছে বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছ থেকে। তারা মনে করছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে রংপুরের পুত্রবধূ হিসেবে শেখ হাসিনা আজ এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণের ঘোষণা দেবেন। তবে বিএনপি নেতাদের দাবি, ভারতপ্রীতির কারণে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে তেমন কোনো আশার আলো দেখাতে পারবেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বুধবার (২ আগস্ট) রংপুর জিলা স্কুল মাঠে মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিভাগীয় মহাসমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। দীর্ঘ এক যুগ পর রংপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন ও এই মহাসমাবেশ ঘিরে উজ্জীবিত দলের নেতাকর্মীসহ রংপুরের সাধারণ মানুষজন।

এদিকে রংপুর বিভাগের মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে বরাবরই একটু বাড়তি প্রত্যাশা করে থাকেন। কারণ তিনি রংপুরের পুত্রবধূ। এবারও এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সমস্যা ও দাবি পূরণে রংপুরের সাধারণ মানুষের মতো রাজনীতিবিদরাও তার দিকে তাকিয়ে আছেন।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) রংপুর জেলা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড শাহাদত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি সরকারের নয় আওয়ামী লীগের জনসভা। এই সভা থেকে দলের লোকজন উপকৃত হবে। রংপুরের মেহনতি মানুষের কোনো কল্যাণ হবে না। নির্বাচনের আগমুহূর্তে আওয়ামী লীগ তাদের প্রচারণার অংশ হিসেবে এই জনসভা করছে। এখানে শেখ হাসিনা দলীয় প্রধান হিসেবে উপস্থিত থাকবেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়।

তিনি আরও বলেন, তিস্তা নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে, এখনও হচ্ছে। তিস্তা ইস্যু এখন প্রহসনে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ তাদের সরকারের মেয়াদপূর্তির আগে মেগা প্রকল্পের কোনো ঘোষণা দেওয়া মানে আরেকটা প্রহসন। রংপুরের ভাষায় ‘ভেজা গামছা দিয়ে গা সোত্তা’র মতো ঘটনা।

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুত্রবধূ হিসেবে শেখ হাসিনা রংপুরে ১৪ বছরে উল্লেখযোগ্য কিছুই করেননি। আমরা ভেবেছিলাম কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে। মেগা প্রকল্প থাকবে কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। বরং রংপুরের উন্নয়ন বৈষম্য দূরীকরণ না করে অর্থ বরাদ্দে রংপুরকে তলানিতে রেখেছে সরকার।

তিনি আরও বলেন, আজ রংপুরে আওয়ামী লীগ জনসভা করছে। এটি আরেকটি প্রতারণার সভামঞ্চ। কারণ এখান থেকে রংপুরের মানুষ তেমন কিছু পাবে না। তিস্তা রংপুরের মানুষের দীর্ঘদিনের সমস্যা। সরকারের ভারতপ্রীতির জন্যই তিস্তা নদী খনন হয়নি। আমরা চাই জনসভা থেকে সারা দেশের মানুষের প্রধান দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দেবেন শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশ জাসদ রংপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজকের মহাসমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা দেবেন, এটা নিয়ে আমরা অধীর আগ্রহে আছি। কারণ অতীতেও প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন রংপুরের জন্য তাই করেছেন। এ কারণে আমাদের বিশ্বাস আজ তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে আশার আলো দেখতে পাবে এই অঞ্চলের মানুষ।

তিনি আরও বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে পিছিয়ে পড়া বৃহত্তর রংপুর দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। সঙ্গে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। রংপুরের মানুষ নদীভাঙনের কবলে প্রতি বছর যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নিঃস্ব হচ্ছেন, তা থেকেও রক্ষা পাবে।

সাব্বির আহমেদ বলেন, সারা দেশেই তো মেগা প্রকল্প চলছে, শুধু রংপুর অঞ্চলে সরকারের কোনো বড় ধরনের প্রকল্প নেই। এই উন্নয়ন বৈষম্য রুখতে হলে সরকারপ্রধানকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট অবস্থান আজ খোলাসা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার ওপর আগামী নির্বাচনেও প্রভাব পড়বে।

তিস্তা বাঁচা, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিস্তা কোটি মানুষের স্বপ্ন, আস্থা এখন শুধুই শেখ হাসিনা। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে রংপুর বিভাগ হবে মিঠাপানি রপ্তানিকারক অঞ্চল। নদীতে ড্রেজিং করে চ্যানেলটা এক হবে, জলাধার নির্মাণ হবে। অকল্পনীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তিস্তাপাড়ের মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে।

তিনি আরও বলেন, তিস্তা নদীতে বিজ্ঞানসম্মত খনন চাই। নদীর দুপাড়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে এর সুরক্ষা চাই। এই সুরক্ষা দিতে গিয়ে এটা মহাপরিকল্পনার নামে হবে, নাকি অন্য কোনো পরিকল্পনায় হবে তা আমাদের অজানা। আমরা জানি না এর অর্থায়ন বিদেশ থেকে নিতে হবে, নাকি দেশ থেকে নিতে হবে। দেশের একটা বৃহৎ জীবনরেখাকে বাঁচাতে হলে এ নদীর পরিচর্যা করতেই হবে। এ অঞ্চলের অর্থনীতিসহ তিস্তা নদী ও নদীপাড়ের মানুষকে বাঁচাতে সুপরিকল্পিত ও বিজ্ঞানসম্মত সুরক্ষার বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রংপুর আগমনে তিস্তার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজের শুরু দেখতে এখন নদীপাড়ের মানুষ মুখিয়ে আছেন।

রংপুর প্রেসক্লাবের সদ্যনির্বাচিত সভাপতি মোনাব্বর হোসেন মনা ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা এলে রংপুরের মানুষের ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন ঘটবে। আমরা বিশ্বাস করি ২ কোটি মানুষের কথা চিন্তা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সুখবর দেবেন। যদিও এ সময়ে তার ঘোষণা বাস্তবায়নে জটিলতা আছে। কিন্তু রংপুরের মানুষ বিশ্বাস করে পুত্রবধূ হিসেবে শেখ হাসিনা কাউকে নিরাস করবেন না।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের (রসিক) মেয়র ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেছেন, তিস্তা নদী উত্তরের মানুষের জন্য বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অঞ্চলের দুই কোটি মানুষের চাওয়া পদ্মা সেতুর মতো জনগুরুত্বপূর্ণ তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হোক। প্রধানমন্ত্রী আজকের মহাসমাবেশ থেকে তিস্তা নিয়ে ঘোষণা দেবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

ঢাকা পোস্টকে সংগ্রাম পরিষদের উপদেষ্টা মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, উত্তরাঞ্চল দেশের শস্যভাণ্ডার হলেও প্রতি বছর তিস্তার কারণে আবাদি জমিসহ ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এভাবে এই শস্যভাণ্ডার বিনষ্ট হতে থাকলে বাংলাদেশকে আমদানি নির্ভরশীল হতে হবে। বিদেশি নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে হলেও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা জরুরি। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশ, প্রতিবেশসহ হুমকিতে পড়বে জীববৈচিত্র্য।

প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বশেষ রংপুরে এসেছিলেন ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর। এ সময় তিনি রংপুরের পীরগঞ্জ ও তারাগঞ্জে দুটি নির্বাচনী জনসভা করেন। সাড়ে ৪ বছরের বেশি সময় পর তিনি আজ আবার রংপুরে এসেছেন। এর আগে ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি রংপুর জিলা স্কুল মাঠে মহাজোটের জনসভায় রংপুরের উন্নয়নের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমজেইউ