ফরিদপুরের নৃত্যশিল্পী মো. কামরুজ্জামান সুমন (৩৮)। ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকে নাচের হাতেখড়ি। এখন নাচের শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন শোতে স্টেজ পারফরমেন্স করেন। টিভি চ্যানেলেও দেখিয়েছেন নৃত্যের চমক। তবে তার আক্ষেপ, আয়োজকদের পক্ষপাত ও প্রতিষ্ঠিত পরিচিতজন না থাকায় বিভিন্ন জাতীয় ও বিদেশি অনুষ্ঠানে তিনি খুব একটা সুযোগ পান না।

কামরুজ্জামান ফরিদপুর শহরের পশ্চিম আলীপুর মহল্লার বাসিন্দা মো. কবির বিশ্বাস ও বিউটি বেগম দম্পতির ছেলে। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়।

কামরুজ্জামান ১০ বছর আগে বিয়ে করেছেন শহরের ওয়্যারলেস পাড়া মহল্লার বীথি জামানকে (৩০)। তাদের নয় বছর বয়সী হাফসা নামের এক মেয়ে রয়েছে। সে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী।

কীভাবে নাচের জগতে আসা, চাহিদার সঙ্গে প্রত্যাশার ফারাক ও বর্তমান বাস্তবতায় নিজের অবস্থান নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের এই প্রতিনিধির সঙ্গে।

গড়নে ছোটখাটো হাসিখুশি এই শিল্পীকে পাওয়া গেল ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলি মহল্লায় গত ২৩ বছর আগে নিজহাতে গড়ে তোলা নাচের প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান নৃত্যাঙ্গন কালচারাল সেন্টারে।

ঢাকা পোস্টকে কামরুজ্জামান জানান, ১৯৯৪ সালে মা বিউটি বেগমের কাছে তার নাচের হাতেখড়ি। ছোটবেলায় মা তার নানাবাড়িতে শিল্পকলার শিক্ষক এনে নাচ শেখাতেন। মা বিউটি বেগম ছিলেন শিল্পমনা। তিনি চাইতেন তার ছেলে বড় হয়ে নৃত্যশিল্পী হোক, নাম করুক।

পশ্চিম আলীপুর মহল্লায় চার ভাই ও মাকে নিয়ে তাদের যৌথ সংসার। সেখানেই একটি সেমিপাকা ও টিনের ঘরে তাদের বসবাস। তার বাবা পুলিশ সদস্য। পারিবারিক জটিলতায় ছোটবেলা থেকেই বাবা অন্যত্র বসবাস করেন। অনেক কষ্ট-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদেরকে বড় করে তুলেছেন মা বিউটি বেগম।

কামরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মা ছোটবেলায় সব সময় আমাদের বলতেন শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে থাকবি। শিল্পের মানুষ অন্য মানুষের চেয়ে আলাদা হয়, শিল্পের মানুষ ভাঙনে নতুন গড়ন দেখতে পায়। ধ্বংসে নতুন অস্তিত্ব খোঁজার শিক্ষা এখানেই পাওয়া যায়।

ছোটবেলায় মায়ের পাশাপাশি সংসারের বড় ছেলে হিসেবে অনেক বেশি সংগ্রাম আর ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন কামরুজ্জামান। ১৯৯৯ সালে নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে শহরের তিতুমীর মার্কেটে দর্জি হিসেবে কাজ করেছেন। যা টাকা পেতেন তা থেকে মায়ের হাতে কিছু দিতেন, বাকী টাকা দিয়ে নাচের সামগ্রী, পোশাক, ঘুঙুর কেনা ও নাচের শিক্ষকের বেতন তিনি নিজেই দিতেন।

কামরুজ্জামান নাচের পাশাপাশি গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি, আনসারউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও বর্তমানে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত। এর ফাঁকে ফাঁকে নাচের জন্য প্রসিদ্ধ শিক্ষক স্বপন কুমার দাস, হাসিবুজ্জামান, আবদুর সাত্তার, খাজা সালাউদ্দিন ঝন্টু, শিবলী মোহাম্মদ, তামান্না রহমান ও ফারহানা চৌধুরী বেবীর কাছে তালিম নিয়েছেন।

এখন ঝিলটুলিতে নিজের প্রতিষ্ঠান নৃত্যাঙ্গন কালচারাল সেন্টারে প্রতি মাসে পাঁচ শ টাকার বিনিময়ে সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থীকে নাচের তালিম দিচ্ছেন তিনি। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে নাচের ক্লাস নিচ্ছেন বোয়ালমারী রূপ কুমার সঙ্গীত নিকেতন, শহরতলীর কোমরপুর এলাকায় অবস্থিত একটি নাচের প্রতিষ্ঠান ও শহরের আদর্শ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে। এসব জায়গায় ২৫ থেকে ৩০ জনের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে।

এর আগে দীর্ঘ পাঁচ বছর প্রতিমাসে মাত্র তিন হাজার টাকা মাসিক বেতনে নাচের ক্লাস নিয়েছেন নগরকান্দা শিল্পকলা একাডেমিতে। শিক্ষা দিয়েছেন ফরিদপুরে কিশোরীদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ফুলকি’র কিশোরী সদস্যদের।

কামরুজ্জামানের জীবনে এত আক্ষেপের ঝুলির মধ্যেও রয়েছে উল্লেখযোগ্য একটি সফলতা। যাকে তিনি তার নাচের জীবনের অন্যতম সফলতা হিসেবে দেখেন। তার নাচের শিক্ষার্থী নীলিমা সেন সঙ্গীতা (২৬) ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীতশাস্ত্রে পড়াশোনা করছেন। নীলিমার মাধ্যমে তার জীবনের স্বপ্ন পূরণ হবে বলে তিনি আশাবাদী।

কামরুজ্জামান জানান, ফরিদপুর শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানসহ দেশের ৩৬টি জেলায় নাচের অনুষ্ঠানে স্টেজ শো করেছেন। ২০১০ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে দেখান তার নাচ। এছাড়া ২০১৬ সালে ফরিদপুরে ধারণকৃত ইত্যাদি অনুষ্ঠানেও তিনি অংশ নেন। ২০১৮ সালে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি অনুষ্ঠানে নাচ করেন। দুয়েকবার অনুষ্ঠান করেছেন বাংলাদেশ টেলিভিশন, এটিএন বাংলা ও চ্যানেল আইয়ে। পেয়েছেন জাতীয় শিশু পুরস্কার, নতুন কুঁড়ি সংগীতালয় পুরস্কার, ঘুঙুর সাংস্কৃতিক পুরস্কার।

ঢাকা পোস্টকে কামরুজ্জামান বলেন, আমার সাংস্কৃতিক কপাল খুব একটা সহায়ক মনে হয় না। অন্তত আমার অভিজ্ঞতা এখানে ভালো নয়। আমরা ঢাকার বাইরে থাকায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিদেশে নাচ-গানের বিভিন্ন সুযোগ থেকে বঞ্চিত হই। তাছাড়া যাদের প্রতিষ্ঠিত আত্মীয়স্বজন থাকে তারা কম যোগ্যতা সত্ত্বেও ওইসব জায়গায় সুবিধা পেয়ে যায়। ইচ্ছে ছিল নিজে বড় নৃত্যশিল্পী হব, নিয়মিত নাচ করবো। টেলিভিশনের পাশাপাশি তালিম দিয়ে নিজের ছায়া হিসেবে রেখে যাব যোগ্য শিষ্য। কিন্তু তা স্বপ্নই রয়ে গেল।

তিনি আরও বলেন, টেলিভিশন প্রোগ্রাম বলেন আর অন্য বড় প্রোগ্রাম বলেন, এমন দুয়েকটি প্রোগ্রাম করে আমার অভিজ্ঞতা যা হয়েছে, এসব জায়গায় প্রোগ্রাম করে যা আয় হয় তার প্রায় পুরোটাই শেষ হয়ে যায় সংশ্লিষ্টদের ‘উপহার’ দিয়ে। নিজের আর কিছু থাকে না। সংশ্লিষ্টদের উপহার দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারি না বলে এসব জায়গায় সুযোগ মিলে না।

কামরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সব অনুষ্ঠান বা সুযোগের ক্ষেত্রে সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক না করে মফস্বলেও নজর দেওয়া দরকার। এতে অন্তত আমাদের মতো অবহেলিত শিল্পীরা নিজেদের প্রমাণের ক্ষেত্রে একটু হলেও জায়গা পাবে। তারপরও শিল্প-সংস্কৃতিতে এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছি এই দুর্মূল্যের বাজারে মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয়েও এই পথ ছাড়িনি। এখন চাইলেও এসব ছাড়তে পারি না।

কামরুজ্জামান সুমনের স্ত্রী বীথি জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিয়ের পর স্বামী অন্য মেয়েদের নাচ শেখাবে, মেয়েদের সঙ্গে নাচবে এটা ভালো লাগত না। এজন্য তাকে তখন নিষেধ করতাম। একসময় বুঝলাম স্বামী এ কাজের মধ্যে আনন্দ এবং জীবনের অর্থ খুঁজে পান। এজন্য পরে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

তিনি আরও বলেন, ‘মাঝেমধ্যে আর্থিক টানাপোড়েনে পড়লে তাকে রাগ হয়ে হয়ে বলি, এসব করে কী পেয়েছ? এরচেয়ে বিদেশ গেলে বেশি উপার্জন করতে পারতা। পরক্ষণেই ভাবি এটা তো তার শৈশবের স্বপ্নের পেশা, চাইলেই ছাড়তে পারবেন না। এসব ভেবে আর পরে কিছু বলি না। তাছাড়া নৃত্যশিল্পী হিসেবে স্বামীকে সবাই সমাদর করে, গুরুত্ব দেয় এসব দেখে আমার ভুল ভেঙে গেছে। আমি বুঝতে পেরেছি মানুষ যে কাজে আনন্দ পায় সে কাজ যদি ঠিকমতো করতে পারে সেটাই তার জীবনের সার্থকতা। প্রতিদিন ভালো খাবার বড় কথা নয়, জীবনের মানে হচ্ছে শান্তিতে বসবাস করা।’

ফুলকি’র ফরিদপুরের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আযম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কামরুজ্জামান ছোটবেলা থেকেই মা-ভক্ত ছেলে। শিল্পমনা মায়ের হাত ধরেই নৃত্য শিখেছে। পাশাপাশি নৃত্যে তার সম্ভাবনাও ছিল অপার। কিন্তু ফরিদপুরে বসবাস এবং যথাযথ সুযোগ না পাওয়ায় তিনি একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে আটকে গেছেন। এখনো যদি সে যথাযথ সুযোগ পায়, তার ঘুরে দাঁড়াবার সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি। আমার চাওয়া এসব প্রতিভাবানদের সুযোগ দেওয়া উচিত। ভালো প্ল্যাটফর্ম পেলে অনেক দূর যাওয়া ও দেশের সুনাম অর্জন করার সক্ষমতা এরা রাখে বলে আমি বিশ্বাস করি।

এমজেইউ