কিডনি রোগীদের সেবায় ‘আব্দুল জলিল হেমোডায়ালাইসিস ইউনিট’
নওগাঁয় কিডনি রোগীদের সেবায় কাজ করছে ‘আব্দুল জলিল হেমোডায়ালাইসিস ইউনিট’।দীর্ঘ ১১ বছর আগে এই ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন করেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বাণিজ্যমন্ত্রী আব্দুল জলিল কিডনি রোগী হওয়ায় ২০১২ সালে নিজের জন্য নওগাঁ সদর হাসপাতালে একটি ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপন করেন। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে ইউনিটটি স্থাপনে অর্থায়ন করেছিল মার্কেন্টাইল ব্যাংক ফাউন্ডেশন। নওগাঁয় থাকা অবস্থায় ওই ইউনিটে ডায়ালাইসিস নিতেন আব্দুল জলিল। পরে জেলার অন্যান্য কিডনি রোগীদের দুর্ভোগের কথা ভেবে ২০১৩ সালে ইউনিটটি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন আব্দুল জলিল। স্থাপন করা হয় আরও চারটি ডায়ালাইসিস মেশিন। মার্কেন্টাইল ব্যাংক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পরিচালিত ইউনিটটির নাম দেওয়া হয় ‘আব্দুল জলিল হেমোডায়ালাইসিস ইউনিট’।
বিজ্ঞাপন
আব্দুল জলিল হেমোডায়ালাইসিস ইউনিটে শুক্রবার ব্যতীত প্রতিদিন এক থেকে দুইটি শিফটে চার ঘণ্টা করে ডায়ালাইসিস সেবা নেন কিডনি রোগীরা। এই সেবা নিতে প্রথম ধাপে নতুন ডায়ালাইজারে দুই হাজার ৮০০ টাকা এবং একই ডায়ালাইজার পুনরায় ব্যবহারে এক হাজার ৯০০ টাকা দিতে হয় রোগীদের। বর্তমানে ২৮ জন কিডনি রোগীকে প্রতি সপ্তাহে সেবা দিচ্ছে এই ডায়ালাইসিস ইউনিট।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিদিন ভোর হলেই আব্দুল জলিল হেমোডায়ালাইসিস সেন্টারে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন সিডিউলে নাম থাকা রোগীরা। তারা এসে প্রথমে নিজেদের ওজন পরিমাপ করেন। ওজন পরিমাপের মধ্য দিয়ে রোগীর শরীরে জমে থাকা বর্জ্য, লবণ এবং অতিরিক্ত তরলের পরিমাণ বের করেন কর্তব্যরত নার্সরা। এরপর তা মেশিনের মাধ্যমে অপসারণ করতে শুরু হয় ডায়ালাইসিস। টানা ৪ ঘণ্টা শুয়ে ডায়ালাইসিস নেওয়াটা রোগীদের জন্য এক প্রকার জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই। এদিকে ইউনিটটির পাঁচটি মেশিন পুরোনো হওয়ায় মাঝেমধ্যেই যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। দীর্ঘদিনের পুরোনো আইপিএসেও প্রায়ই নানাবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সময়মতো ঠিক করতে না পারায় রোগীদের প্রায়ই পড়তে হয় ভোগান্তিতে। এছাড়া প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ পেতে দেরি হওয়ায় একটি মেশিন দীর্ঘ দুই মাস যাবত বন্ধ হয়ে আছে। জেলায় প্রতিনিয়ত কিডনি রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও এখনো বাড়েনি এখানকার মেশিনের সংখ্যা ও জনবল। এতে প্রায়ই ব্যাহত হচ্ছে ডায়ালাইসিস সেবা কার্যক্রম। তাই বাধ্য হয়ে অনেক রোগীকে ডায়ালাইসিস নিতে পার্শ্ববর্তী জেলা রাজশাহী, বগুড়া ও জয়পুরহাটে যেতে হচ্ছে। তাই আব্দুল জলিল হেমোডায়ালাইসিস ইউনিটটিতে শয্যা সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারিভাবে ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন রোগীরা।
বিজ্ঞাপন
শহরের স্টেডিয়ামপাড়ার কিডনি রোগী রফিকুল ইসলাম সাত মাস যাবত ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া প্রায়ই ব্যথানাশক ট্যাবলেট খেতেন তিনি। এতে ১২ বছর আগে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিলে জানতে পারেন তিনি কিডনি রোগে আক্রান্ত।
রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েও সুস্থ হতে পারিনি। একপর্যায়ে দুটি কিডনি শতভাগ বিকল হলে ডায়ালাইসিস শুরু করি। শুরুতে এখানে সিরিয়াল না পাওয়ায় বেশ কয়েকবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ডায়ালাইসিস নিতে হয়েছে। পরে এখানে সিরিয়াল পাওয়ায় খরচের পাশাপাশি ভোগান্তিও কমেছে।
রফিকুল ইসলামের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেনারেল হাসপাতাল এবং ডায়ালাইসিস ইউনিটে কিডনি বিশেষজ্ঞ একজন চিকিৎসকও নেই। যখনই ডায়ালাইসিস শুরু হয় আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। যদিওবা নার্সরা পর্যাপ্ত সেবা দিয়ে সহযোগিতা করেন। কিন্তু চিকিৎসক থাকলে দুশ্চিন্তা কমতো। অনেক সময় ডায়ালাইসিস চলমান অবস্থায় বেডে শুয়েই রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকলে রোগীদের এই মৃত্যুহার কমতো। পুরাতন মেশিন পরিবর্তন করে ইউনিটটিতে আধুনিক ডায়ালাইসিস মেশিন স্থাপন এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগে সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
শানজিদা আক্তার সাথী এসেছেন কিডনি রোগী সালমা বেগমকে নিয়ে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক বছর যাবত মা ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন। মাঝেমধ্যেই ডায়ালাইসিস মেশিনের সমস্যা দেখা দেয়। ইঞ্জিনিয়ার আসতে অনেক দেরি করায় মেশিন নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। তখন রোগীরা সেবা নিতে পারেন না। ছুটে যেতে হয় পার্শ্ববর্তী জেলা রাজশাহী ও বগুড়ায়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের আরও আন্তরিক হওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
আরেক কিডনি রোগী এবাদুল হক দুই বছর যাবত আব্দুল জলিল হেমোডায়ালাইসিস ইউনিটে ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন। পেশায় তিনি একজন সাংবাদিক। এবাদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হিমোগ্লোবিন ইনজেকশনসহ প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এখানে মেডিকেল কলেজ ও জেনারেল হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও কোনো সরকারি ডায়ালাইসিস ইউনিট নেই। পার্শ্ববর্তী জেলা জয়পুরহাটের সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। সেখানকার রোগীরা মাসে ৮ হাজার টাকায় সেবা পাচ্ছে। অথচ আমাদের খরচ অনেক টাকা। প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটাই দাবি নওগাঁয় সরকারিভাবে ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপন হোক।
ডায়ালাইসিস ইউনিটের সিনিয়র স্টাফ নার্স মেমি খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়। দুজন নার্সের মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই একজনকে অন্য ডিউটিতে দেওয়া হয়। তখন রোগীদের নিয়ে পড়তে হয় বিপাকে। একা সেবা দেওয়া যায় না।
ডায়ালাইসিস ইউনিটের ইনচার্জ হায়াত মাহুমদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন রোগী মারা না যাওয়া পর্যন্ত আরেকজনকে সেবা দেওয়ার কোনো সুযোগ এখানে নেই। প্রতিনিয়ত রোগীদের চাপ বাড়ছে। কিন্তু এখানে একসঙ্গে এত রোগীকে সেবা দেওয়ার মতো মেশিন ও জনবল নেই। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ পজিটিভ রোগী এলে। পজিটিভ মেশিন না থাকায় অসংখ্য রোগীকে অন্যত্র রেফার্ড করতে হয়। এতে রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বর্তমানে পজিটিভ মেশিনসহ আধুনিক প্রযুক্তির বেশকিছু নতুন মেশিন জরুরি হয়ে পড়েছে। আধুনিক মেশিন স্থাপন করা হলে সেবার মান আরও বাড়বে।
আব্দুল জলিল হেমোডায়ালাইসিস ইউনিটের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রয়াত নেতার (আব্দুল জলিল) রেখে যাওয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক কিডনি রোগী উপকৃত হচ্ছেন। এখান থেকে কোনো লাভ নেয় না মার্কেন্টাইল ব্যাংক ফাউন্ডেশন। প্রথম দিকে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকলেও আব্দুল জলিলের মৃত্যুর পর চিকিৎসকরা বদলি হয়ে চলে গেছেন। এখন অভিজ্ঞ নার্সরাই ইউনিটটি পরিচালনা করছেন।
তিনি আরও বলেন, জেলায় আগে মেডিকেল কলেজ না থাকলেও বর্তমানে মেডিকেল কলেজ হয়েছে। যেখানে আগামীতে অসংখ্য কিডনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আসবেন। আব্দুল জলিল হেমোডায়ালাইসিস ইউনিটের পাশাপাশি এখানে সরকারিভাবে একটি ইউনিট স্থাপন করলে ব্যয়বহুল এ চিকিৎসার ব্যয় কমে আসবে। জেনারেল হাসপাতালে গণপূর্তের মাধ্যমে সরকারি ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপনের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারিভাবে একটি ১০ শয্যার ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপন নিয়ে ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে চিঠি পেয়েছি। আশা করছি শিগগিরই সেটি বাস্তবায়ন করা হবে।
এমজেইউ