নাটোরের কাঁচাগোল্লা

নাটোরের বিখ্যাত মিষ্টান্ন কাঁচাগোল্লা। যেটি খেয়ে দেখেননি কিংবা নাম শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। নাটোরের সেই কাঁচাগোল্লা ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড ছাড়াও ভ্রাম্যমাণভাবে ভেজাল কাঁচাগোল্লা বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। ভেজাল কাঁচাগোল্লা বিক্রি বন্ধে সোচ্চার নাটোরবাসী। 

সরেজমিনে নাটোর রেলস্টেশন গিয়ে দেখা যায়, ছোট ছোট প্যাকেট নিয়ে বগিতে বগিতে কাঁচাগোল্লা বিক্রি করছেন ফেরিওয়ালারা। সেখানে প্রতিকেজি কাঁচাগোল্লা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা দরে। দাম নিয়ে ট্রেনের যাত্রীদের দরকষাকষি করে নিতে দেখা গেছে। তবে ভ্রাম্যমাণভাবে বিক্রি করা এসব কাঁচাগোল্লার দাম দোকানের তুলনায় অর্ধেক। ফলে দাম কম হওয়ায় অনেকেই কিনছেন এসব কাঁচাগোল্লা।

সদর উপজেলার আগদীঘা এলাকার রনি ইসলাম। তিনি দ্রুতযান এক্সপ্রেসে নাটোর থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন। ট্রেনে কাঁচাগোল্লা বিক্রি হচ্ছে দেখে দাম জিজ্ঞেস করেন তিনি। ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতার ৩৫০ টাকা কেজি দাম শুনে কিছুটা অবাক হলেন তিনি। তিনি একটি প্যাকেট নিয়ে খুলতেই আসল কাঁচাগোল্লার সঙ্গে এর পার্থক্য বুঝতে পারলেন।

এ সময় রনি বলেন, তিনি নাটোরের স্থানীয়। তিনি আসল কাঁচাগোল্লা চেনেন। কিন্তু ট্রেনে থাকা অনেক মানুষ যারা আসল কাঁচাগোল্লা কোনটি জানেন না। তারা এসব কাঁচাগোল্লা কিনছেন, কিন্তু তারা প্রকৃত স্বাদ পাবে না। ফলে কাঁচাগোল্লার স্বাদ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরি হবে তাদের মধ্যে। ফলে কাঁচাগোল্লার সুনাম বাজার উভয়ই নষ্ট হবে। ভেজাল কাঁচাগোল্লা বিক্রি বন্ধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন রনি।

ট্রেনে এভাবেই নাটোরের কাঁচাগোল্লা নামে বিক্রি করা হচ্ছে

একই চিত্র নাটোর বাসস্ট্যান্ড এলাকাতেও। সেখানে গেলে দেখা যায়, ব্যাগ ভর্তি কাঁচাগোল্লা নিয়ে বিক্রি করছেন কয়েকজন ব্যক্তি। সেখানে ৪০০ টাকা কেজি দরে কাঁচাগোল্লা বিক্রি হচ্ছে। এখানে রেলস্টেশনের তুলনায় ৫০ টাকা কেজিতে বেশি। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ বিক্রেতা জানান, তার মতো আরও ৫ থেকে ৭ জন এভাবে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ফেরি করে কাঁচাগোল্লা বিক্রি করেন। তারা নাটোর থেকে আশপাশের জেলাগুলোতে চলাচলকারী বিভিন্ন বাসের যাত্রীদের কাছে এগুলো বিক্রি করেন বলে জানান।

কাঁচাগোল্লাকে জিআই পণ্যের স্বীকৃতিতে উচ্ছ্বাস প্রকাশের পাশাপাশি ভেজাল কাঁচাগোল্লা বিক্রি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন নাটোরের সিনিয়র গণমাধ্যম ও সমাজকর্মী ইসহাক আলী। তিনি বলেন, কাঁচাগোল্লার এই স্বীকৃতি নাটোরবাসীকে সম্মানিত করেছে। তাই এখন আমাদের প্রয়োজন এই সম্মান ধরে রাখা। সেই সম্মান ধরে রাখতে হলে কাঁচাগোল্লার বিকৃতি ও ভেজাল তৈরি বন্ধে প্রশাসনের পাশাপাশি সচেতন নাটোরবাসীকে সজাগ থাকতে হবে। কাঁচাগোল্লার জিআই স্বীকৃতিতে সুশীল সমাজের আয়োজনে আনন্দ র‍্যালি হওয়ার কথা থাকলেও শোকের মাস হওয়াতে আয়োজনটি সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। 

তিনি বলেন, শুধু ভ্রাম্যমাণভাবেই যে ভেজাল কাঁচাগোল্লা বিক্রি হয় বিষয়টি তেমন নয়। ঐতিহ্যবাহী এই কাঁচাগোল্লা দীর্ঘদিন ধরে বিকৃত আকারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হয়ে আসছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশের নামকরা একটি খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান নাটোরে তাদের ব্রান্ড শপে গোলাকার কাঁচাগোল্লা বিক্রি শুরুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়।

নাটোরের প্রসিদ্ধ কাঁচাগোল্লা তৈরির আদী কারখানা শহরের লালবাজার এলাকায় জয়কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এর স্বত্বাধিকারী প্রভাত কুমার পালের এক কেজি কাঁচাগোল্লা তৈরিতে খরচ পরে ৪৫০- ৫০০ টাকা। সেই জায়গায় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় কাঁচাগোল্লা বিক্রি হচ্ছে শুনে বেশ অবাকই হন তিনি। তিনি বলেন, বাপ- দাদার সময় থেকে কাঁচাগোল্লা তৈরি করে আসছি। তাদের এ কর্ম ধরে রাখতে আজও আমরা কাঁচাগোল্লা তৈরি করছি। সারা দেশে কাঁচাগোল্লার সুনাম ও খ্যাতি রয়েছে আমাদের দোকানের। তিনি জোর দিয়ে বলেন ঐ দামে বিক্রি করা ঐসব আসল কাঁচাগোল্লা হতে পারে না। ফলে কাঁচাগোল্লার সুনাম ও খ্যাতি ধরে রাখতে এখনি ভ্রাম্যমাণভাবে কাঁচাগোল্লা বিক্রি বন্ধে প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানান তিনি।

ট্রেন স্টেশন, বাসস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন জায়গায় বিকৃত কাঁচাগোল্লা বিক্রি বন্ধের বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নাটোরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান জানান, কাঁচাগোল্লা ভেজাল বন্ধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিভিন্ন সময় জেলার পর্যটনের জায়গাগুলোতে অভিযান পরিচালনা করেছে। এখন যেহেতু কাঁচাগোল্লা জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। সেহেতু এগুলো বন্ধে আরও জোরদার অভিযান চালানোর কথা জানান এই কর্মকর্তা। তিনি জানান, ফেরিওয়ালাদের জন্য কিছুটা আইনি ছাড় থাকলেও কাঁচাগোল্লার ক্ষেত্রে এখন থেকে আর ছাড় দেওয়া হবে না।

এ বিষয়ে নাটোর জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভূঁঞা বলেন, আগে থেকেই ভেজাল কাঁচাগোল্লা তৈরি এবং বিক্রি বন্ধে জেলা প্রশাসন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে আসছে। এখন কাঁচাগোল্লার সঙ্গে জিআই পণ্যের নতুন একটি পরিচিতি যুক্ত হয়েছে। যার দরুন ভেজাল রোধে আগের চেয়ে বেশি অভিযান পরিচালনা করা হবে। ভেজাল উৎপাদন এবং বিপণনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

প্রসঙ্গত, ঐতিহ্যবাহী নাটোরের এই কাঁচাগোল্লাকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) নিবন্ধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন নাটোরের সাবেক জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ। চলতি বছরের ৩০ শে মার্চ শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) বরাবর নাটোরের কাঁচাগোল্লাকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন পাঠায় জেলা প্রশাসন। যার ফলশ্রুতিতে গত ৮ আগস্ট জিআই পণ্যে স্বীকৃতি পায় নাটোরের কাঁচাগোল্লা।

শাহিনুল আশিক/এএএ