ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা উত্তোলনকারীদের টার্গেট করা হয়। টাকা তুলে যাওয়ার পথে গতিরোধ করে কখনো র‌্যাব কিংবা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয় দিয়ে প্রাইভেটকারে তুলে নেন ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা। পরে হাত-পা ও চোখ-মুখ বেঁধে টাকা নিয়ে মহাসড়কের নির্জন স্থানে নামিয়ে দিয়ে পালিয়ে যান তারা। মাদারীপুরে রাজৈর উপজেলায় এই চক্রের কাছে টাকা খুইয়েছেন অনেকেই। গ্রাহকের লাখ লাখ টাকা খোয়া গেলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে চক্রের মূলহোতারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার ইশিবপুরে এজেন্ট ব্যাংক পরিচালনা করেন আরাফাত হোসেন নবীন। তার প্রতিষ্ঠানের কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার আল-মুমিন মোল্লা সম্প্রতি টেকেরহাটের মেঘনা ব্যাংক থেকে ১২ লাখ টাকা নিয়ে গন্তব্যে রওনা দেন। মাঝপথে ছিনতাইকারীরা ডিবি পরিচয় দিয়ে তার গতিরোধ করে প্রাইভেটকারে তুলে নেয়। পরে তার সব টাকা ছিনতাই করে ৩০ কিলোমিটার দুরে মহাসড়কের নির্জন স্থানে চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় ফেলে রেখে যায়।

একইভাবে এই চক্রের কাছে টাকা খুইয়েছেন কবিরাজপুরের কেরামত আলী শিকদার, নারায়নপুরের গিয়াস শেখ। তাদের মতো আতঙ্কে টেকেরহাট বন্দরের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে আসা গ্রাহকরা।

অভিযোগ রয়েছে, বার বার একই স্টাইলে গ্রাহকদের লাখ লাখ টাকা খোয়া গেলেও উদ্ধারে তৎপরতা নেই পুলিশের। ব্যাংক কর্মকর্তাদের দাবি, এই চক্রটি শক্তিশালী হওয়ায় মুহূর্তেই বেশি টাকা উত্তোলনের খবর বাইরে চলে যায়। আর ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক ব্যবহার করে সটকে পড়ে এ সকল চোর চক্রের সদস্যরা।

অভিজিৎ ঘোষ নামে এক গ্রাহক বলেন, ব্যাংক থেকে টাকা তুললেই ছিনতাইয়ের কবলে পড়তে হচ্ছে। এমন ঘটনা দীর্ঘদিনের। প্রতিনিয়ত ভয় হয়, আমরা নিরাপত্তা চাই। যাতে কোনো ধরনের বিপদ না হয়। অহিদুল ইসলাম নামে একজন বলেন, সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিনিয়ত পুলিশি টহল জোড়দার করতে হবে। যাতে অপরাধীরা আতঙ্কে থাকে। এছাড়া তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা উচিত। নাহলে একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

ভুক্তভোগী আরাফাত হোসেন নবীন বলেন, চলতি মাসের ১৩ আগস্ট ১২ লাখ টাকা খোয়া গেলেও পুলিশের কাছ থেকে সহযোগিতা পাইনি। বেশ কয়েকবার থানায় গিয়েছি, অপরাধী ধরার ব্যাপারে তৎপরতা নেই, আর টাকা উদ্ধারেও দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই পুলিশের।

আরেক ভুক্তভোগী কেরামত আলী শিকদার বলেন, আমার কবিরাজপুর ও কালামৃধা এই দুই জায়গায় আলাদা দুটি এজেন্ট ব্যাংক রয়েছে। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা বহন করতে হয়। আমার প্রতিষ্ঠানের ক্যাশিয়ার আবু মো. সায়েম গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর ‘আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড’ টেকেরহাট শাখা থেকে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে আসার সময় র‌্যাব পরিচয়ে প্রাইভেটকারে তুলে একটি চক্র। পরে টাকা নিয়ে সড়কের মধ্যেই তাকে ফেলে পালিয়ে যায়। এখনো উদ্ধার হয়নি খোয়া যাওয়া টাকা।

আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক টেকেরহাট শাখার ব্যবস্থাপক মো. ছামাদ বিশ্বাস বলেন, টেকেরহাট বন্দরে ১৫টি ব্যাংকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা লেনদেন হয়। গত দুই বছরে ছোটবড় মিলিয়ে বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে টেকেরহাট বন্দর ও আশপাশের এলাকায়। এই চক্রটি দীর্ঘদিন যাবৎ এমন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত মোটা অঙ্কের টাকা উত্তোলনের খবর ব্যাংক থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে। গ্রাহক বেশে ব্যাংকে প্রতিনিয়ত ঘোরাফেরা করছে চক্রটি। আমরাও এর প্রতিকার চাই।

মেঘনা ব্যাংক টেকেরহাট শাখার ব্যবস্থাপক মো. আরিফুর রহমান বলেন, আমরাও অবাক হই। টাকা লেনদেনের খবর কীভাবে প্রতারক চক্র পায়। মূলত এই চক্রটি দীর্ঘসময় একজন গ্রাহককে নজরদারিতে রাখে। এই চক্রটিতে অসংখ্য লোক কাজ করে। সম্প্রতি টাকা খোয়া যাবার ঘটনায় খুবই দুঃখজনক। অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, এর আগে ছিনতাইকারী চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ব্যাংক এলাকায় দুইজন অফিসারের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিম কাজ করছে। এছাড়া সকল ব্যাংক ম্যানেজারদের নিয়ে মিটিং করেছি ও প্রতিটি ব্যাংকে পুলিশি নিরাপত্তার জন্য পোস্টার লাগানো হয়েছে। সর্বনিম্ন কেউ তিন লাখ টাকা উত্তোলন করলেই তাকে পুলিশের সহযোগিতা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

রাজৈর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলমগীর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সম্প্রতি ১২ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় একজনকে আমরা শনাক্ত করেছি এবং তিনি ঢাকায় একটি ঘটনায় ধরা পড়েছেন। প্রতারকদের ধরতে ও গ্রাহকদের নিরাপত্তায় ব্যাংক এলাকায় কাজ করছে পুলিশের একটি টিম।

রাকিব হাসান/এএএ