সুন্দরবনের মধুর খ্যাতি দেশজুড়ে। আর এই মধুকে ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করেন খুলনা অঞ্চলের মৌয়ালরা। সুন্দরবনের খাঁটি মধুর চাহিদা দেশ-বিদেশে ব্যাপক। সেই সুযোগটাকে কাজে লাগাচ্ছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। 

তারা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় সুন্দরবনের মধুর চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, খুলনা, মোংলাসহ সুন্দরবনের আশপাশের এলাকায় খাঁটি মধুর নামে চালাচ্ছেন ভেজাল মধুর ব্যবসা। প্রাকৃতিক খাঁটি মধুর নামে বাড়িতে বা কারখানায় চিনি, রং, ফিটকিরি, মধুর ফ্লেভারসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর জিনিস মিশিয়ে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করছে ভেজাল মধু (নকল মধু)। যা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

যেভাবে তৈরি করা হয় ভেজাল মধু

খুলনা জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মো. মোকলেছুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভেজাল মধু তৈরিতে মূলত ৫টি জিনিস ব্যবহার করে। চিনি, ফিটকিরি, ফ্লেভার, রং ও আঠালো গ্লুকোজ সিরাপ ব্যবহার করা হয়।

ভেজাল মধু তৈরির জন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রথমে হাড়িতে পানি দিয়ে চিনি জ্বালিয়ে নেয়। এরমধ্যে ফিটকিরি দেয়, যাতে চিনি জ্বালানোর পর লালচে রং ধারণ না করে। মধুটা স্বচ্ছ হয়। যে ব্রান্ডের মধু তারা বানাবে ওই ব্রান্ডের রং ও ফ্লেবার মিশিয়ে নেয়। সুন্দরবনের মধু ও কালিজিরা মধু এই দুটি ব্রান্ডের মধু তারা বেশি ভেজাল তৈরি করে। এই মধুর চাহিদা বেশি এবং দামও বেশি। লিচু, সরিষা ও বরই ফুলের মধু ভেজাল কম হয়। এগুলোর দাম কম, যেকারণে ভেজাল করে তাদের লাভ হয় না। তবে সরিষা ফুলের মধু পুরাতন হলে তার সঙ্গে চিটাগুড় ও কালিজিরা পাউডার মিশিয়ে কালিজিরা মধু তৈরি করে।

ভেজাল মধু মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর

নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা বলেন, বাঙালিদের একটা ঐতিহ্য আছে শিশু জন্ম নিলে তার মুখে প্রথমে মধু দেয়। তাহলে জন্মের পর যদি চিনি ফিটকিরি দিয়ে বানানো ভেজাল মধু দেওয়া হয়। তারমানে একটি শিশুর জন্মের পর তার মুখে ভেজাল খাবার দেওয়া হল। আমরা মধু খেয়ে থাকি রোগের প্রতিষেধক হিসেবে। ভেজাল মধু খেয়ে আমরা মধুর পুষ্টিগুণ এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। এই ধরনের মধু প্রধানত সমস্যা সৃষ্টি করে কিডনিতে। বিভিন্ন ভেজাল খাবার খেয়ে কিডনি রোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফিটকিরি যুক্ত মধু যদি প্রতিনিয়ত খাওয়া হয় তাহলে পেটের মধ্যে ক্ষত তৈরি করতে পারে। সেই ক্ষত থেকে আলসার এবং আলসার থেকে ক্যান্সারও হতে পারে। এর দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব রয়েছে।

এদিকে সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে খুলনা মহানগরের আড়ংঘাটা থানা এলাকার সিটি বাইপাস সড়কে ভেজাল মধু তৈরির কারখানা থেকে ১০৫ কেজি ভেজাল মধু ও ২ জনকে আটক করে ডিবি পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে ভেজাল মধু তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

আটকৃতরা হলেন, সাতক্ষীরা শ্যামনগরের মাথুরাপুর এলাকার আশরাফুল ইসলাম রিপন (৩৪) ও শ্যামনগরের বাদঘাটা এলাকার শেখ শাহরিয়ার মাসুদ (৩৮)।

খুলনা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মো. নুরুজ্জামান জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খুলনা মহানগর ডিবি পুলিশের একটি টিম আড়ংঘাটা থানাধীন সিটি বাইপাস সড়কের আকমানের মোড়স্থ এলাকায় একটি কারখানায় নকল ও কথিত মধু (ভেজাল মধু) উৎপাদিত হচ্ছে বলে জানতে পারে। সোমবার দুপুর পৌনে ৩ টার দিকে ওই এলাকাট বাইতুস শরিফ জামে মসজিদের পূর্ব পাশে জনৈক অপু সাহেবের টিনসেড বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে ১০৫ কেজি ভেজাল মধু এবং ভেজাল মধু তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।

খুলনা মহানগর ডিবি প্রধান বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে ভেজাল চিনি, ফিটকিরি কেমিক্যাল গ্লুকোজ ও অন্যান্য সরঞ্জাম চুলায় ফুটিয়ে নেয়। ওই মিশ্রণ ঠান্ডা হলে তাতে অনেক সময় মধুর ফ্লেভার আনার জন্য সামান্য পরিমাণ মধু মেশানো হয়। এরপর ওই মিশ্রণ বোতলজাত করে তার গায়ে 'অর্গানিক বিডি'র লেবেল লাগিয়ে বাজারজাত করা হয়। এভাবেই তৈরি হয়ে যায় সুন্দরবনের খাঁটি মধু। এই মধু তারা অনলাইন এবং অফলাইনে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে। যা পরবর্তীতে খাঁটি মধু হিসেবে ভোক্তার কাছে যায়। এই মধু জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকারক। এতে কিডনি নষ্ট হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।

ভেজাল মধু ও মধু তৈরির সরঞ্জামের মধ্যে ছিল- একটি হলুদ রংয়ের প্লাস্টিকের তৈরি ড্রামে রক্ষিত ১০ কেজি চিনি সিরা, ফ্রেস ২ লিটারের পানির বোতলে রক্ষিত জ্বালানো মধু, যা রং হিসেবে মধু তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। সাদা প্লাস্টিকের কৌটায় রক্ষিত ফিটকিরি চূর্ণ, একটি সাদা প্লাস্টিকের বস্তায় রক্ষিত ১২ কেজি চিনি, একটি প্লাস্টিকের পানির জার, একটি নীল রংয়ের প্লাস্টিকের অর্ধেক ড্রাম, যা মধু রাখার কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া একটি এক বার্নার বিশিষ্ট গ্যাসের চুলা, একটি গ্যাস সিলিন্ডার, একটি ডিজিটাল পরিমাপক যন্ত্র, ১৪টি প্লাস্টিকের তৈরি নীল কর্কযুক্ত সাদা রংয়ের বোতল, কাঁচের তৈরি বোয়েম ১২ টি, সাদা রংয়ের প্লাস্টিকের তৈরি ছোট কৌটা ২৪টি, সাদা কর্কযুক্ত প্লাস্টিকের ছোট বোতল ৩৬টি, একটি সবুজ রংয়ের প্লাস্টিকের তৈরি কর্ক (মধু ঢালার পাত্র) এবং কালো জিরা ফুলের মধু লেখা স্টিকার ৫টি।

খুলনা জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মো. মোকলেছুর রহমান বলেন, আশরাফুল ইসলাম রিপন ও তার বাবা আব্দুর রশিদ ওরফে চিনি রশিদ সাতক্ষীরার শ্যামনগরে ভেজাল মধুর কারখানা বানিয়ে বিপুল পরিমাণ ভেজাল মধু তৈরি করত। সাতক্ষীরায় বানালেও সেগুলো খুলনা এনে ডেলিভারি দিতো বিভিন্ন অঞ্চলে। রিপনের গোটা পরিবার এই ভেজাল মধু তৈরির সঙ্গে জড়িত। আমি সাতক্ষীরা থাকাকালীন ভেজাল মধু জব্দ করেছিলাম। এ বিষয়ে রিপন ও তার পিতাকে আসা্মি করে মামলা দায়ের করেছিলাম। এই ভেজাল মধু তৈরি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছে রিপন। শুনেছি খুলনায় চারতলা একটি বাড়িও করেছে। বর্তমানে খুলনায় থেকে ভেজাল মধু তৈরি করছিল। ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করেছে। 

মোহাম্মদ মিলন/আরকে