পরকীয়ার বলি নাইম, মরদেহ পুঁতে ওপরে সবজি চাষ
ছেলে নাইমের মৃত্যুর খবরে মায়ের আহাজারি
বিয়ের পর পারিবারিক কলহ। পাঁচ মাসের কোলের ছেলে নাইম হোসেনকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বাবার বাড়িতে চলে আসেন গোলাপী বানু। বাবার বাড়িতে এসে নাইমকে নিয়ে জীবনের পথচলা শুরু। দেখতে দেখতে নাইম ২৩ বছরে পা দিয়েছে। একমাত্র ছেলে নাইমকে ঘিরে মায়ের রঙিন স্বপ্ন ছিল। সন্তানের মুখ চেয়ে গোলাপী বানু তার স্বামীর সংসারে আর ফিরে যাননি। বাবার পাওয়া জায়গায় বাড়ি বানিয়েছিলেন। সেখানেই মা-ছেলের দিন সুখেই কাটছিল। নাইম উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করে মায়ের সংসারের হাল ধরেছিলেন। তবে মায়ের সেই রঙিন স্বপ্নের সমাধি ঘটলো। একমাত্র অবলম্বন ছেলে নাইম হোসেন (২৩) বাজারে যাওয়ার কথা বলে গত ২২ এপ্রিল বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি।
ছেলে নিখোঁজ হওয়ার সাড়ে চার মাস পার হলেও মেলেনি খোঁজ। এই সময়ে ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে শুকিয়ে গেছে তার মায়ের চোখের জল। তখন থেকেই মা গোলাপী বানু বাড়িতে একাই বসবাস করছেন। নাইম ফিরে আসবে বলে পথ চেয়ে থাকতেন তিনি। তবে গোলাপী বানুর আর পথচেয়ে বসে থাকতে হবে না। ছেলের সন্ধান মিলেছে। তবে জীবিত নয়, ছেলে নাইমের মরদেহ সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় বাড়িতে পৌঁছেছে।
বিজ্ঞাপন
এমন ঘটনা ঘটেছে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার ধরঞ্জী বাজার এলাকায়। গত শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাতে ওই এলাকার সামছুল ইসলামের বাড়ির গোসলখানা নির্মাণের জন্য টয়লেটের পাশে মাটি খনন করার সময় মানুষের হাড়গোড়সহ গলিত মরদেহ পাওয়া যায়। শনিবার রাত ৯টার দিকে মরদেহটি উদ্ধার করে পুলিশ। পরে প্যান্ট, বেল্ট দেখে মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন নাইমের পরিবার।
ঘটনার পর বাড়ির মালিক সামছুল ইসলামকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল। পরে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। সামছুলের বাড়ির ভাড়াটিয়া এক দম্পতি রেজ্জাকুল ওরফে রাজ্জাক ও তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন পলাতক রয়েছেন। রাজ্জাকের স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে পরকীয়ার কারণে নাইম হোসেনকে হত্যা করে মরদেহ গুম করতে মাটি খুঁড়ে লুকিয়ে রাখা হয় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
নাইম হোসেনের বাবার নাম মাসুদ রানা। তার বাবার বাড়ি জয়পুরহাট সদর উপজেলার চকবরকত ইউনিয়নের ভূটিয়াপাড়া গ্রামে। তবে নাইম হোসেন কোনোদিন তার বাবার বাড়িতে যাননি। নাইম পাঁচবিবি উপজেলার ধরঞ্জী গ্রামে তার নানার বাড়িতেই বড় হয়েছেন। তিনি তার বাবাকেও কোনোদিন দেখেননি। আবার নাইমের বাবাও কোনোদিন ছেলের খোঁজ নেয়নি। এসব ক্ষোভ, কষ্ট আর হতাশায় নাইম নিজের বাবার কখনো পরিচয় দিতেন না। তিনি সবাইকে বলতেন তার বাবা মারা গেছেন। নাইম তার জাতীয় পরিচয়পত্রেও বাবাকে মৃত দেখিয়েছেন। নাইম নিখোঁজের পর তার মামা ওহেদুল ইসলাম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ওই জিডিতে নাইমের বাবা মৃত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল বিকেলে নাইম হোসেন বাজারে যাওয়ার পর আর বাড়িতে ফিরেননি। এরপর ২৫ এপ্রিল নাইমের নিখোঁজের ঘটনায় পাঁচবিবি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর রাতে ধরঞ্জী গ্রামের সামছুল ইসলামের বাড়ির মাটি খুঁড়ে সম্পূর্ণ একটি মরদেহের মাথার খুলিসহ হাড়গোড় উদ্ধার করেন পুলিশ। ওই লাশের পড়নের প্যান্ট, বেল্ট ও মাথার চুল দেখে সেগুলো নিখোঁজ নাইমের বলে শনাক্ত করেন পরিবার। পরে থানায় হত্যা মামলা করা হয়।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, ধরঞ্জি গ্রামের সামছুল ইসলামের দুই পরিবার। তিনি গ্রামের পুরাতন বাড়িতে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করতেন। নতুন বাড়িতে প্রথম স্ত্রী রেনু আরা এক সন্তান নিয়ে থাকতেন। প্রায় এক বছর আগে সামছুল তার নতুন বাড়িতে রেজ্জাকুল ওরফে রাজ্জাক নামে বগুড়ার শিবগঞ্জ এলাকার এক ব্যক্তিকে ভাড়া দেন।। স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে রেজ্জাকুল বাড়িটিতে ভাড়া থাকতেন। রেজ্জাকুল ধরঞ্জী গ্রামে কয়েক বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন। নাইমের বাড়ি এলাকায় রেজ্জাকুলের কলার বাগান ছিল। রেজ্জাকুল ও তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন ওই কলার বাগান পরিচর্যা করতে প্রায়ই আসতেন। তখন রেজ্জাকুলের সঙ্গে নাইমের সখ্যতা হয়। নাইম রেজ্জাকুলের ভাড়া বাড়িতেও যেতেন।
গত ২২ এপ্রিল বিকেলে নাইম বাজারে যাওয়ার পর আর বাড়িতে ফেরেননি। এরপর ২৫ এপ্রিল নাইমের নিখোঁজের ঘটনায় তার মামা ওহেদুল ইসলাম পাঁচবিবি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। কোরবানি ঈদের কয়েক দিন পর সামছুলের প্রথম স্ত্রী রেনুকা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এ সুযোগে তার ঘর থেকে একটি নোটবুক চুরি হয়। এতে রেজ্জাকুলকে সন্দেহ করা হয়। তখন তাকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলা হয়। ঈদের দশ দিন পর রেজ্জাকুল বাড়ি ছেড়ে দিয়ে গ্রামের অন্য একটি বাড়িতে গিয়ে ওঠেন।
গত ৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে সামছুল তার বাড়িতে টয়লেটের পাশে গোসলখানা বানাতে রাজমিস্ত্রি লাগান। মিস্ত্রিরা গোসলখানার জায়গার লাউ, কুমড়া, পুঁইশাকের গাছ কেটে মাটি সড়াতে গেলে দুর্গন্ধযুক্ত কাপড় দেখতে পান। তখন রাজমিস্ত্রিরা বাড়ির মালিক সামছুলকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গিয়ে ঘটনাটি পুলিশকে জানায়। পুলিশ শনিবার রাত ৯টায় মাটি খুঁড়ে সম্পূর্ণ গলিত একটি লাশের মাথার খুলিসহ হাড়গোড় উদ্ধার করেন। সে সময় নাইমের মা ও স্বজনেরা সেখানে ছুটে আসেন। তারা পড়নের প্যান্ট, বেল্ট ও মাথার চুল দেখে সেগুলো নিখোঁজ নাইমের বলে শনাক্ত করেন।
সামছুলের স্ত্রী রেনু আরা বলেন, ভাড়াটিয়া রেজ্জাকুল টয়লেটের পাশে ফাঁকা জায়গায় লাউ-কুমড়ার গাছ লাগিয়েছিলেন। লাউ-কুমড়ার গাছের নিচে মাটি খুঁড়ে বস্তাবন্দি মাথার খুলি ও হাড়গোড় পাওয়া গেছে।
রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে নিখোঁজ নাইম হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির দরজায় সামনে নাইমের মা গোলাপী বানু বিলাপ করছিলেন। এ সময় স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। বিলাপ করতে-করতে নাঈমের মা বলছিলেন, সাড়ে চার মাস আগে নাইম বাড়ি থেকে যে প্যান্ট পরে বেড়িয়েছিল মাথার খুলি ও হাড়গোড়গুলোর সঙ্গে সেই প্যান্ট পাওয়া গেছে। হাত-পা বেঁধে বস্তায় ভরে মাটিতে পুঁতে রেখেছিল। ‘মোর কলিজাক ওরা কত কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলেছে। মুই এর সুষ্ঠ বিচার চাই, ওদের ফাঁসি চাই।’
“মামলায় ওই বাড়ির ভাড়াটিয়ার স্ত্রীর সঙ্গে নাইমের পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল বলে উল্লেখ রয়েছে। এরই জেরে নাইমকে হত্যা করে মরদেহ গুমের জন্য মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। মামলার এক আসামি ওই বাড়ির মালিক সামছুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
মো. জাহিদুল হক, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), পাঁচবিবি থানা, জয়পুরহাট
নাইমের খালাতো ভাই তরিকুল ইসলাম বলেন, নাইম হোসেন ২২ এপ্রিল রাত ৮টার দিকে ধরঞ্জী বাজারে যাওয়ার কথা বলে বাইরে বের হয়ে আর বাড়ি ফেরেননি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাকে না পেয়ে ২৫ এপ্রিল পাঁচবিবি থানায় জিডি করা হয়েছে। জিডি করার সাড়ে চার মাস পার হলেও নাইমের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই মরদেহ উদ্ধারের পর তার পড়নের প্যান্ট, বেল্ট ও মাথার চুল দেখে নাইমের মরদেহ বলে শনাক্ত করা হয়।
নাইমের মামা ওহেদুল ইসলাম বলেন, পারিবারিক কলহের কারণে আমার বোন গোলাপী বানু পাঁচ মাসের সন্তান কোলে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। পরে তিনি আর স্বামীর সংসারে ফিরে যাননি। ভগ্নিপতিও কোনো দিন বোনকে নিতে আসেননি। ভাগিনা নাইমকেও দেখতে আসেননি। ভাগিনাও তার বাবাকে দেখেনি। এ কারণে ভাগিনা নাইম ক্ষোভে-কষ্টে তার জাতীয় পরিচয়পত্রে বাবাকে মৃত দেখিয়েছে। ভাগিনা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে আমার বোন পথ চেয়ে থাকত। মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে ভাগিনার মরদেহ এসেছে। তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। এখন আমার বোন একা হয়ে গেল।
পাঁচবিবি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহিদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাটি খুঁড়ে বস্তাবন্দি অবস্থায় গলিত লাশের মাথার খুলি, হাড়গোড় ও পড়নের কাপড় পাওয়া গেছে। উদ্ধার হওয়া আলামতগুলো নাইম হোসেনের। এ ঘটনায় থানায় তিনজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা হয়েছে। মামলার বাদী নিহতের মা গোলাপী বানু। মামলায় ওই বাড়ির ভাড়াটিয়ার স্ত্রীর সঙ্গে নাইমের পরকীয়া ছিল বলে উল্লেখ আছে। এরই জেরে নাইমকে হত্যা করে মরদেহ গুমের জন্য মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। মামলার এক আসামি ওই বাড়ির মালিক সামছুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।
ওসি বলেন, জিডির পর নিখোঁজ নাইমের সন্ধানে তার ব্যবহৃত মোবাইল ট্রাকিং করে পাওয়া যায়নি। পুলিশ শুরু থেকেই উদ্ধারে তৎপর ছিল।
চম্পক কুমার/এএএ