চলতি বছরের ২৫ এপ্রিলে ঈদের ছুটিতে নানা বাড়ি ঝালকাঠি সদরের নাপিতখালি গ্রামে বেড়াতে গিয়ে সকালের দিকে খালে পড়ে নিখোঁজ হয় দুই বোন সোনালী (৮) ও রূপালী। পরে ‍বিকেলে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল তাদের মরদেহ উদ্ধার করে। পরিবারের অভিযোগ, তারা সময়মতো ফায়ার সার্ভিসের সহায়তা পাননি। 

সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) গবেষণা বলছে দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ পানিতে ডুবে মারা যান বরিশাল বিভাগে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত জরিপ বলছে, বিভাগে প্রতিদিন পানিতে ডুবে ৯ জন শিশুর মৃত্যু হয়। যা যথারীতি ভয়াবহ। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি দক্ষিণাঞ্চলে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুকে মহামারি বলে ঘোষণা দেয়।

ঘটনার আকস্মিকতায় পানিতে ডুবে যাওয়া ব্যক্তি উদ্ধারে তাৎক্ষণিক ডাক পরে ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষিত ডুবুরি দলের। অথচ কাজের সময় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলকে পাওয়া যায় না। সর্বশেষ ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় জনসংখ্যা রয়েছে ৯১ লাখের বেশি। কিন্তু নদী প্রধান এই জনপদের এত বিশাল জনসংখ্যার নিরাপত্তায় ডুবুরি রয়েছে মাত্র ৭ জন।

এরমধ্যে তিনজন ডুবুরি বিভাগীয় উপ-পরিচালকের দপ্তরে, তিনজন বরিশাল নদী ফায়ার স্টেশনে নিযুক্ত। তবে নদী ফায়ার স্টেশনে নিযুক্ত তিনজনের মধ্যে একজনকে পটুয়াখালী নদী স্টেশনে প্রেষণে যুক্ত রাখা হয়েছে। ওই স্টেশনে আরও একজনকে রাঙ্গামাটি থেকে প্রেষণে এনে রাখা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ডুবুরি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্ষা মৌসুমে মানুষের ডুবে যাওয়ার ঘটনা বেড়ে যায়। তখন দিনে ৩/৪ জায়গা থেকে ফোন আসে। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে যাওয়া হয় না।

ডুবুরিরা বলেন, প্রতিটি দুর্ঘটনা মোকাবেলা করতে চারজনের টিম থাকতে হয়। এরমধ্যে একজন স্ট্যান্ডবাই রাখতে হয়। পানির নিচে যদি কোনো ডুবুরি বিপদে পড়েন তাকে উদ্ধারের জন্য। কিন্তু বরিশাল বিভাগে ডুবুরির সংকট থাকায় অনেক সময় একজনকেই উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে হয়। যা সত্যিই অসম্ভব। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এ কাজ করতে হয়।

নৌ-ফায়ার স্টেশনের অভাব:

নদী রক্ষা কমিশনের সর্বশেষ প্রকাশিত জরিপ বলছে, বরিশাল বিভাগে ৯৯টি নদী রয়েছে। কয়েকশো খাল রয়েছে। নদীর আধিক্য থাকায় পানিতে ডুবে মৃত্যু, নৌ পথে অগ্নি দুর্ঘটনাও এই অঞ্চলে বেশি ঘটে। যার ফলে বরিশাল বিভাগে নৌ-ফায়ার স্টেশনের প্রয়োজনীয়তাও বেশি। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন।

ফায়ার সার্ভিস থেকে জানা গেছে, নদী বেষ্টিত এই বিভাগে পটুয়াখালী এবং বরিশালে দুটি নৌ-ফায়ার স্টেশন রয়েছে। পিরোজপুর, ভোলা, বরগুনা, ঝালকাঠির এসব উপকূলীয় জেলায় কোনো নৌ-ফায়ার স্টেশন নেই। স্থল স্টেশনেও পিছিয়ে এই বিভাগ। বিভাগের ৬ জেলার ৪২ উপজেলার মধ্যে ৩৮টি উপজেলায় ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন রয়েছে। এরমধ্যে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত স্টেশন মাত্র ৩টি, ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত ২৩টি ও ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত ১০টি। আর ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত স্থল কাম নৌ-ফায়ার স্টেশন নেই একটিও।

বরিশাল জেলার মুলাদী উপজেলায় ও বরগুনার তালতলী উপজেলায় স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। তবে বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া এবং পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলায় ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা এখনো নেই। তাছাড়া বরিশাল নগরী এবং কুয়াকাটায় একটি স্টেশন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের দু’জন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, দক্ষিণাঞ্চলে কয়েকটি অব্যবস্থাপনার কারণে সড়কে দুর্ঘটনা যেমন বেড়েছে তেমনি নদী পথেও বড় বড় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনা মোকাবেলা করতে যে পরিমান স্টেশন এবং সক্ষমতা দরকার তা নেই। শুধু স্থল স্টেশনের প্রতি খেয়াল রাখলে চলছে না এই বিভাগে আরও কয়েকটি নৌ-ফায়ার স্টেশন করা দরকার।

অভাব আধুনিক জাহাজের:

২০২১ সালের ডিসেম্বরে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে চলন্ত এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে ৪০ জনের মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালের মে মাসে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতে নোঙর করে রাখা এমটি এবাদী-১ তেলের ট্যাংকারের ইঞ্জিন রুমে বিস্ফোরণে বাবা-ছেলেসহ ৬ জন প্রাণ হারান। একই বছরের জুলাইয়ে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে নোঙর করে রাখা সাগর নন্দিনী-২ তেলবাহী জাহাজে দুই দফা বিস্ফোরণে চারজন নিহত ও ১৫ জন আহত হন।

দেশের মধ্যে এই তিনটি আলোচিত নৌ-অগ্নিকাণ্ড মোকাবেলায় সরাসরি অংশ নিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের বরিশাল নৌ-ফায়ার স্টেশনে সংযুক্ত জাহাজ ‘অগ্নিযোদ্ধা’। অথচ অগ্নিযোদ্ধা পরিচালনার জন্য যে জনবলের দরকার তা নেই। ফলে নৌপথে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে সময়মতো এবং তড়িৎগতিতে পৌঁছাতে পারেন না অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরা।

চালক এনামুল হক বলেন, ঝালকাঠির অভিযান ১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে অগ্নিযোদ্ধা নিয়ে যাত্রা করে কিছুদূর গেলে জাহাজটি বিকল হয়ে পড়ে। আমরা বিকল্প উপায়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দুই বছর ধরে জাহাজটি চালানোর জন্য কোনো চালক নেই। কোথাও যেতে হলে অগ্নিযোদ্ধার বড় বড় পাঁচটি ইঞ্জিন আমাকে চালু করতে হয়। আবার মাস্টার ব্রিজে থেকে জাহাজ চালিয়ে নিতে হয় গন্তব্যে। একই সময়ে একজনের পক্ষে দুটি কাজ করা অসম্ভব।

অগ্নিযোদ্ধা পরিচালনার জন্য কমপক্ষে পাঁচজন দরকার বলে মনে করেন তিনি। শুধু সেটাই নয় আরেক জাহাজ ‘অগ্নিঘাতক’ও চালাতে হয় তাকে। এছাড়াও তিনটি স্পিডবোট চালানোর জন্য নিযুক্ত আছেন রিপন সিকদার নামে মাত্র একজন চালক।

জানা গেছে, অগ্নিযোদ্ধা জাহাজটিও বরিশাল নৌ-ফায়ার স্টেশনের জন্য বরাদ্দ নয়। এটি কিশোরগঞ্জের নিকলী হাওরে বরাদ্দ হলেও সেখান থেকে পটুয়াখালী নদী ফায়ার স্টেশনের জন্য সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু পটুয়াখালীতে রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যা থাকায় বরিশাল নদী স্টেশনে এনে রাখা হয়েছে।

গবেষক আনিসুর রহমান স্বপন বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সেক্টরটি সম্পূর্ণরূপে অবহেলিত। বড় কোনো দুর্ঘটনার পর এর সক্ষমতা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হলে কেন্দ্র থেকে দু-একটি স্পিডবোট বরাদ্দ দিয়ে প্রচার চালানো হয়। এমনও ঘটনা ঘটেছে, স্পিডবোট চালাতে যে চালক দেওয়া হয় তিনি সাঁতারও জানেন না। আসলে বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে নৌ-ফায়ার স্টেশন ও তাদের সক্ষমতা। কয়েকদিন আগে ঝালকাঠিতে বড় বড় দুটি দুর্ঘটনা ঘটলো। তখন ফায়ার সার্ভিস সড়ক পথে গিয়ে ট্রলার নিয়ে নদীর আগুন নেভাতে দেখেছি। এটি আমাদের সঙ্গে এক ধরনের পরিহাস। নদী তীরে তেলের ডিপো নির্মাণ করা হচ্ছে, বড় বড় নৌযান নামছে। এসবের নিরাপত্তার জন্য আগে দরকার নৌ ফায়ার স্টেশন নির্মাণ করা। আর যেগুলো আছে সেগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো। কিন্তু তা করা হচ্ছে না, যার ভুক্তভোগী আমরা, খেসারত দিচ্ছি প্রাণের বিনিময়ে।

নদী ফায়ার স্টেশনে কর্মরত কয়েকজন অগ্নিনির্বাপণ কর্মী বলেন, ঝালকাঠিতে দ্বিতীয় দফায় যখন তেলের জাহাজে বিস্ফোরণ হলো তখন বরিশাল বিভাগের ফায়ার স্টেশনগুলোর ফোম শেষ হয়ে গিয়েছিল। খুলনা থেকে ফোম এনে কাজ চালাতে হয়। প্রয়োজনের তুলনায় দরকারি সরঞ্জামও অনেক সময়ে থাকে না। তারপরও আমাদের কাজ চালাতে হয়। এছাড়া বিকল হয়ে পড়ে আছে অগ্নিঘাতক নামের জাহাজটি। অন্যসব বিভাগের নদী স্টেশনে ৩০/৪০ জন জনবল থাকলেও বরিশালে রয়েছে ১৫ জন।  

অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরাই স্বীকার করেন, নদী ফায়ার স্টেশনটির গ্রেড উন্নতি না করলে এবং সংকট নিরসন না করায় আগুন মোকাবেলায় সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না।

ফায়ার সার্ভিসের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক বেলাল উদ্দিন বলেন, নদী ফায়ার স্টেশনে অগ্নিযোদ্ধা চালাতে আমাদের ইঞ্জিন চালক দরকার। বরিশাল নদী মাতৃক অঞ্চল। এই অঞ্চলে ডুবুরি সংখ্যা বাড়ানো দরকার। নৌপথে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম ও যানবাহন যুক্ত করা উচিত। আমাদের যে জনবল সংকট রয়েছে তাতে আনুপাতিক হারে জনবল বাড়াতে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আমরা আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারবো।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এএএ