২০০১ সালের ১৫ ডিসেম্বর। ঈদের আগের রাত। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রসববেদনা নিয়ে ভর্তি ছিলেন হাফসা আক্তার মেরি। ওইদিন তার সিজার হওয়ার কথা থাকলেও দায়িত্বরত চিকিৎসক সিজার না করেই চলে যান। তবে এক ইন্টার্ন চিকিৎসকের চেষ্টায় তার কোলজুড়ে আসে মেয়ে তাফসিয়া রহমান উর্বি। সেই নারী ইন্টার্ন চিকিৎসকের প্রতি মুগ্ধ হয়ে তখনই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন তার মেয়েও একদিন বেছে নেবে মহান এ পেশা। মায়ের সেই স্বপ্নের বাস্তব প্রতিফলনই ঘটালেন মেয়ে উর্বি। সদ্য প্রকাশ হওয়া মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে পঞ্চম স্থান অধিকার করে ২০ বছর আগে মায়ের বোনা স্বপ্ন পূরণ করলেন তিনি।

এমন ফলাফলে স্বভাবতই আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কমতি নেই তাফসিয়া রহমান উর্বির পরিবারে। ফল প্রকাশের পর থেকেই আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে শিক্ষক, সহপাঠী ও ময়মনসিংহবাসীর শুভেচ্ছায় সিক্ত হচ্ছেন উর্বি। এতে আপ্লুত তার বাবা-মা।

জানা গেছে, বাবা-মা আর ভাইকে নিয়ে চারজনের পরিবারে বড় মেয়ে তাফসিয়া রহমান উর্বি। বাবা উবায়দুর রহমান আকন্দ রাজধানীর ডিসেন্ট ফার্মা ল্যাবরেটরি লিমিটেডের সেলস ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ও মা হাফসা আক্তার মেরি একজন গৃহিণী। একমাত্র ভাই মাহিন মুন্তাসির তূর্য ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী।

ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন উর্বি। ময়মনসিংহের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শেষ করেন। পরে ভর্তি হন মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজে। এইচএসসিতেও পান জিপিএ-৫। এরপর তার মনের ভেতর লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে এমবিএস ভর্তি পরীক্ষার জন্য কঠোর প্রস্তুতি নেন উর্বি। যার পরিপ্রেক্ষিতে মেডিকেলের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের তালিকায় সেরা পাঁচে নাম লিখাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। 

প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছেন উর্বি

সোমবার (৫ এপ্রিল) রাতে নগরীর আকুয়া চৌরঙ্গী মোড় এলাকার নিজ বাসায় গেলে এমন দুর্দান্ত সাফল্যের পেছনের গল্প জানান উর্বি। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ছোটবেলায় মা তার ইচ্ছার কথা জানালেও তিনি কখনো তা আমার ওপর চাপিয়ে দেননি। তবে সব দিক থেকে বিবেচনা করে মনে হয়েছে মানুষের সেবা করার এমন প্রত্যক্ষ সুযোগ আমি অন্য কোনো পেশায় পাব না। সে মতোই মেডিকেল প্রস্তুতি ও ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি। 

কেমন ছিল এমবিবিএস ভর্তির প্রস্তুতি? এমন প্রশ্নে উর্বি বলেন, পড়াশোনায় আমার কোনো বিরক্তি ছিল না। এটি আমার পছন্দই ছিল। যেহেতু আমার আগ্রহ মেডিকেলের দিকে ছিল সেজন্য আমি এইচএসসি প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েই নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। এইচএসসি সিলেবাসের প্রতিটি অধ্যায় ধরে ধরে সম্পন্ন করেছি যেন কোনো কমতি না থাকে। 

মেডিকেলের প্রস্তুতি নেওয়ার চিন্তা থাকলে প্রতিদিনের একাডেমিক পড়া প্রতিদিন শেষ করার পরামর্শ হবু এ চিকিৎসকের। উর্বি বলেন, অনেক শিক্ষার্থীকে দেখতাম সারা বছর না পড়ে পরীক্ষার আগে জমিয়ে একবারে পড়ে ফেলার চেষ্টা করত। কিন্তু আমি এই কাজটি করতাম না। আমি নিয়মিত পড়ালেখাতে বিশ্বাসী ছিলাম। আমি শুরু থেকেই প্রতিদিন রুটিন করে পড়েছি। দিনের পড়া দিনে শেষ করেছি। কিন্তু মাঝেমাঝে যে বিরক্ত লাগেনি তা নয়। বিরক্তি আসলে আমি দুই-তিনদিন বিরতি নিয়ে নতুন উদ্যমে পড়ালেখা শুরু করতাম।

করোনার কারণে গত এক বছর বেশ উদ্বেগের মধ্যদিয়ে কেটেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এইচএসসি পরীক্ষা বার বার পেছানোর কারণে সেই সময়টায় অনেক উদ্বিগ্ন ছিলাম। এরপর এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষাটাও হচ্ছিল না। তখন প্রতি মাসেই মনে হতো যে সামনের মাসেই হয়তো ভর্তি পরীক্ষা হবে। এ সময়টাতে বাবা-মায়ের কাছ থেকে মানসিকভাবে অনেক সাপোর্ট পেয়েছি। 

ফল প্রকাশের পর অনুভূতি জানতে চাইলে উর্বি বলেন, বিকেলের পর ফল প্রকাশ হবে জানা সত্ত্বেও ফজরের নামাজের পর থেকেই ওয়েবসাইট খুলে বার বার দেখেছি। বিকেল থেকে খুবই উদ্বেগ কাজ করছিল। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হওয়ায় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগও চলে যায়। পরে এক সময় কোচিং থেকে ফোন করে রেজাল্টের খবর জানালে আমি শুরুতে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যখন নিজের চোখে দেখেছি তখন বিশ্বাস করেছি। ৩-৪ ঘণ্টা দুশ্চিন্তা করার পর এমন ফল পেয়ে আমি তখন ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। ওই সময়ের অনুভূতি আসলে প্রকাশ করার মতো না। পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরেছিলাম। তখন বাবা-মা দুইজনই আনন্দে কান্না করছিল।

মেয়ের এ সাফল্যে উচ্ছ্বসিত ও গর্বিত বাবা উবায়দুর রহমান আকন্দ ও মা হাফসা আক্তার মেরি। ঢাকা পোস্টকে উবায়দুর রহমান বলেন, বই পড়া ছিল মেয়ের নেশা। সে কখনো চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি, এতেই আমি সন্তুষ্ট। পড়াশোনার জন্য তাকে কোনো চাপ দিতে হয়নি। তার এ সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান তার মায়ের। আমার মেয়ে মানবিক চিকিৎসক হোক, এটিই আমার চাওয়া। 

আবেগাপ্লুত মা হাফসা আক্তার মেরি বলেন, মেয়ের সততা আমাদের মুগ্ধ করত। মানুষের সেবা করার মন-মানসকিতা তার মধ্যে আছে। সে যত বড় ডাক্তারই হোক না কেন সে কখনো দেশের বাইরে যাবে না, দেশে থেকেই মানুষের সেবা করবে। এটিই তার ইচ্ছা। আমি মহান আল্লাহর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ। তিনি আমার স্বপ্ন পূরণ করেছেন। 

মেডিকেলে সেরা পাঁচে স্থান দখল করায় গর্বিত তার বিদ্যাপীঠ ও শিক্ষকরা। বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আনোয়ার কাদের ঢাকা পোস্টকে বলেন, উর্বি সেরা হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে সে কখনো না বুঝে কোনো কিছু পড়ত না। তার মধ্যে সৃজনশীলতা ও নিজস্বতা বজায় ছিল। তার মতো মেধাবীর শিক্ষক হয়ে আমিও গর্বিত। সারাজীবনই তার মঙ্গল কামনা করব এবং মনেপ্রাণে চাইব তার সেবাও যেন আমরা নিতে পারি। তার জন্য নিরন্তর শুভ কামনা।

মায়ের লালিত স্বপ্ন পূরণ করে কাঙ্ক্ষিত মেডিকেল কলেজের দরজার কড়া নাড়ছেন আত্মবিশ্বাসী উর্বি। এখন স্বপ্ন দেখেন কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিবিএস সম্পন্ন করে দেশের মানুষের সেবা করার। পাশাপাশি মেডিসিন নিয়ে গবেষণা করারও প্রবল ইচ্ছা তার মনে।

এসপি