১০ বছর আগেও তিন বেলা খাবার নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকত মাদারীপুর সদর উপজেলার দুধখালি ইউনিয়নের হাউসদি গ্রামের মানুষ। এখন পাশের গ্রামের মানুষকেও সহযোগিতা করে তারা। গ্রামের অধিকাংশ পরিবার স্বাবলম্বী। প্রবাসীদের ছোঁয়ায় বদলে গেছে গ্রামটি।

হাউসদি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কুমার নদী। গ্রামের পথ ধরে হাঁটলে চোখে পড়বে সুন্দর বাড়িঘর ও পরিপাটি রাস্তাঘাট। কোথাও আবর্জনার স্তূপ নেই। কাদা-বালুর সড়ক নেই, নেই বাঁশের সাঁকো। আঁকাবাঁকা পিচঢালা সড়কে মাঝেমধ্যে দেখা যাবে সেতু ও কালভার্ট। আছে ইটের সলিং সড়ক।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম্য পুলিশ জানান, গ্রামে প্রায় ১৫০০ মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ৩০০ জন প্রবাসী। সৌদি আরব, কুয়েত, আবুধাবি, মালয়েশিয়া, জার্মানি ও ইতালিতে রয়েছেন তারা। তবে ইতালিপ্রবাসী বেশি। প্রায় সব পরিবারে দু’একজন প্রবাসী আছেন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, কেউ কেউ দীর্ঘদিন প্রবাসে কাটিয়ে গ্রামে এসে ব্যবসা করছেন; মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগলের খামার গড়েছেন। পরিবারকে সচ্ছল করার পাশাপাশি কর্মসংস্থান তৈরি করেছেন। এভাবে এক পরিবার থেকে আরেক পরিবার সচ্ছল হচ্ছে। যারা এখনো প্রবাসে, তারা টাকা পাঠান। পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের বিদেশে নিয়ে যান। একে একে স্বাবলম্বী হয় পরিবারগুলো।

গ্রামের পথ ধরে হাঁটলে চোখে পড়বে সুন্দর বাড়িঘর

গ্রামের রেমিট্যান্স-যোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম ফারুক খান। তিনি মৃত হাজী আব্দুল লতিফ খানের বড় ছেলে। চার ভাই চার বোন ও মাকে নিয়ে তার পরিবার। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় ছাত্রজীবন থেকেই ব্যবসা করতেন। তাতে সংসারে সচ্ছলতা আসেনি। সচ্ছলতা ফেরাতে ১৯৯২ সালে ২০ হাজার টাকা খরচ করে ইতালিতে পাড়ি জমান। বিদেশে রেস্টুরেন্টে কাজ শুরু করেন। চার বছর পর নিজেই রেস্টুরেন্ট দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি কোটিপতি হয়ে যান। এরপর ছোট দুই ভাইকে বিদেশ নিয়ে যান। পাশাপাশি গ্রামের নানা উন্নয়নকাজে সহযোগিতা করেন। 

২৭ বছর পর দেশে ফিরে ব্যবসা শুরু করেন ফারুক খান। সেই সঙ্গে গ্রামের মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, রাস্তাঘাট মেরামত ও তৈরিতে সহযোগিতা করেন। করোনা মহামারিতে নিজ গ্রাম ও দুধখালি ইউনিয়নের ১৪ গ্রামের মানুষের মাঝে ২০ লাখ টাকার ত্রাণ বিতরণ করেন তিনি। সদর উপজেলায় শপিং মল, দোকানপাট নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠান খুলে অনেকের কর্মসংস্থান করেছেন। বর্তমানে ফারুক খান জেলা পরিষদের সদস্য। আগামীতে দুধখালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে চান তিনি।

গ্রামের এক প্রবাসীর বাড়ি

ফারুক খান বলেন, ইতালিতে বাংলাদেশিদের ছোটখাটো অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। ইতালিতে প্রচুর কাজ ও মানুষের চাহিদা রয়েছে। কাজের জন্য সবসময় নিজের ভেতর চেষ্টা থাকতে হবে।

ফারুক খানের হাত ধরে ১৯৯৮ সালে ১৭ বছর বয়সে ইতালিতে পাড়ি জমান মেজ ভাই রহমান খান। প্রায় দুই যুগ পার করেছেন প্রবাসে। নিজের ভাগ্য বদলে ফেলেছেন। ইতালিতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন। তার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন ১৫ জন বাংলাদেশি। বাড়িঘর ও মসজিদ-মাদরাসা ও গ্রামের রাস্তাঘাটের উন্নয়নে ভূমিকা রয়েছে তার। বিপুল অর্থের মালিক তিনি।

রহমান খান বলেন, মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিতে হবে। সততার সঙ্গে অর্থ উপার্জন করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নিজের ভাগ্য নিজেকেই বদলাতে হবে। ভাগ্য বদলের চেষ্টা থাকতে হবে নিজের। কারণ কারও ভাগ্য কেউ বদলাতে পারে না।

গ্রামের অধিকাংশ পরিবার স্বাবলম্বী

গ্রামের মৃত কৃষক ফজেল হাওলাদারের ছেলে রিপন হাওলাদার। সংসারে অভাব থাকায় পড়াশোনা করতে পারেননি। পরিবারের আর্থিক সংকট দূর করতে ১৫ বছর আগে সৌদি আরবে পাড়ি জমান। দিনরাত ওভারটাইম কাজ করে টাকা জমান তিনি। সাত বছরের মাথায় সৌদি আরবে কাপড়ের দুটি ও ও সেলুনের দোকান দেন। প্রতি মাসে ২০ লাখ টাকা আয় তার। প্রতি বছর গ্রাম ও আশপাশের অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করেন তিনি। পাশাপাশি কয়েকজনকে বিদেশে নিয়েছেন। তার হাত ধরে বিদেশ গিয়ে অনেকেই স্বাবলম্বী।

রিপন হাওলাদার বলেন, বিদেশে গিয়ে প্রথমে অনেক কষ্ট করেছি। প্রতিদিন ১৫ ঘণ্টা করে কাজ করেছি। আজকের অবস্থানে আসতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সবাইকে পরামর্শ দেব, যারা বিদেশ যাবেন অবশ্যই প্রশিক্ষণ নিয়ে যাবেন। বিদেশে কাজ না করলে কোনো মূল্য নেই।

রিপন হাওলাদারের প্রতিবেশী ওয়াহিদুজ্জামান কাজলের বাবা নুরুল আমিন ছিলেন প্রাথমিকের শিক্ষক। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে উচ্চশিক্ষার জন্য ২০১২ সালে মালয়েশিয়ায় যান কাজল। সেখানে যাওয়ার পর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। স্টুডেন্ট ভিসায় বিদেশ গিয়ে জানতে পারেন ট্যুরিস্ট ভিসায় এসেছেন। তাকে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় দালালরা। পড়াশোনা করা হয়নি তার।

গ্রামের উন্নয়নেও সহায়তা করেন প্রবাসীরা

তবু হাল ছাড়েননি। পড়াশোনার চিন্তা বাদ দিয়ে কাজে লেগে যান। কয়েক বছর পরিশ্রম করে স্বাবলম্বী হন। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে মালয়েশিয়ায় নিয়েছেন। তারাও স্বাবলম্বী। ২০১৮ সালে দেশে ফিরে আমদানি-রফতানি ব্যবসা শুরু করেন। সেই সঙ্গে কয়েকজনকে ব্যবসার কাজে সহযোগিতা করেছেন। পাশাপাশি গ্রামের উন্নয়নে সহায়তা করেছেন।

ওয়াহিদুজ্জামান কাজল বলেন, বিদেশে বেশি পরিশ্রম করতে হবে। সেখানে অর্থ-অপচয়ের প্রচুর জায়গা আছে। এসব কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারলে সফলতা নিশ্চিত। তবে কাজের বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, আমরা বিদেশে অর্থ উপার্জনের জন্য এসেছি।

দীর্ঘদিন প্রবাসে কাটিয়ে গ্রামে এসে ব্যবসা করছেন অনেকেই

হাউসদি বাজারে চটপটি বিক্রি করতেন শুক্কুর ফরাজী। মা-বাবা ও এক ছেলে মেয়ে নিয়ে অভাবের সংসার। চটপটি বিক্রির টাকায় সংসার চলছিল না। এক বিঘা জমি বিক্রি করে ২০২০ সালে ইতালি যান। এক বছরেই তিনি সফলতা দেখিয়েছেন।

শুক্কুর ফরাজীর স্ত্রী রোকসানা বলেন, চটপটি বিক্রি করে দিনে ৪০০- ৫০০ টাকা আয় হতো। তা দিয়ে সংসার চলছিল না। এখন ভালো আছি। বিদেশ থেকে স্বামী টাকা পাঠায়। চলতে কষ্ট হয় না।

তাদের মতো একই গ্রামের সফল প্রবাসী রফিক মাতুব্বর, কানন ব্যাপারী, এহসান আজগর, মামুন ব্যাপারী, সেলিম খান, ওমর ফারুক ও বিল্লাল খান। গ্রামের ৩০০ প্রবাসীর মধ্যে অধিকাংশই সফল। যাদের পরিশ্রমে বদলে গেছে গ্রামের চিত্র। হয়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন।

গ্রামের পাকা রাস্তা 

এদিকে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় প্রতারণা বেড়েছে দালালদের। বিদেশ নেওয়ার কথা বলে অসহায় পরিবারগুলোর কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে তারা।

দালালদের খপ্পরে পড়ে ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি অবৈধ পথে সাত লাখ টাকায় বিদেশে পাড়ি জমান রঙমিস্ত্রি মাহবুব খান (৩৫)। তাকে লিবিয়া নিয়ে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে আরও পাঁচ লাখ টাকা নেয় দালালরা। পরে লিবিয়ার ব্যাঙাচি থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ট্রলারডুবিতে মাহবুব মারা যান। আজ পর্যন্ত তার মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। জমি বিক্রি করে দালালদের ১২ লাখ টাকা দিয়ে মাহবুবের পরিবার নিঃস্ব। আজো থামেনি মাহবুবের মায়ের আহাজারি।

মাহবুব খানের মা আমেনা বেগম বলেন, ছেলেকে লিবিয়া থেকে জাহাজযোগে ইতালি নেওয়ার কথা ছিল। এজন্য দালালদের প্রথমে সাত লাখ টাকা দিয়েছি। পরে তাকে জিম্মি করে আরও পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছে। কেউ যেন অবৈধ পথে বিদেশে না যায়; এটি আমার অনুরোধ।

শুধু হাউসদি নয়; পাশের বলসা গ্রামেরও আর্থ-সামাজিক অবস্থা বদলে গেছে। সহস্রাধিক ব্যক্তি ইতালি, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান, দুবাই, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে থাকেন। অধিকাংশ পরিবার সচ্ছল।

সদর উপজেলার মধ্যে দুধখালী ইউনিয়নে প্রবাসীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ইউনিয়নের ১৪টি গ্রামে প্রায় পাঁচ হাজার প্রবাসী রয়েছেন।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পরিবারে অভাব, পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না পাওয়ার অনিশ্চয়তা, হতাশা ও ঋণগ্রস্ত এবং উন্নত জীবনের আশায় ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ যান।

দুধখালী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) সারাব উদ্দিন বলেন, সদরের ইউনিয়নগুলোর মধ্যে সবচেয় বেশি প্রবাসী হাউসদি গ্রামে। প্রবাসে গিয়ে ভাগ্য বদলে ফেলেছেন তারা। দেশে ফিরে কেউ কেউ ব্যবসা করছেন। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে মানুষের।

৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) মো. শাহিন মোল্লা বলেন, বলসা গ্রামের প্রচুর মানুষ প্রবাসে থাকেন। অধিকাংশ বেকার বিদেশে গিয়ে আজ সফল। আবার ১৬-১৭ বছরে কেউ কেউ বিদেশ যাচ্ছেন। এরপরও গ্রামে অনেক বেকার রয়েছেন। তবে গ্রামে অনেক উন্নয়ন হয়েছে।

বলসা গ্রামের প্রচুর মানুষ প্রবাসে থাকেন। অধিকাংশ বেকার বিদেশে গিয়ে আজ সফল

দুধখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান খান বলেন, ইউনিয়নে পাঁচ হাজারের বেশি লোক বিদেশে থাকেন। এসব পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে; দারিদ্র্য কমেছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শিক্ষিতের হার কমেছে। সন্তানদের পড়াশোনা করানোর আগ্রহ কমেছে মা-বাবার। আমি চাই মানুষ শিক্ষিত হয়ে বিদেশে যাক; তাহলে আরও ভালো করবে।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুদ্দিন গিয়াস বলেন, অন্য জেলার তুলনায় মাদারীপুরে প্রবাসী বেশি। প্রবাসীরা করোনায় সমস্যায় ছিলেন। এখন ভালো আছেন। করোনায় যেসব প্রবাসী দেশে এসেছেন তারা ফিরতে পারেননি। এজন্য লোনের ব্যবস্থা করেছে সরকার। মাদারীপুরে ট্রাস্ট টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (টিটিটিআই) ট্রেনিং দিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়।

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) রহিমা খাতুন বলেন, ট্রেনিং দিয়ে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করছি আমরা। আগে শিক্ষিত হবে; পরে ট্রেনিং নিয়ে বিদেশ যাবে। বিভিন্ন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে। ট্রেনিং ছাড়া বিদেশে নয়। কয়েকদিন আগে সেমিনার করেছি। সেমিনারে প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বার উপস্থিত ছিলেন। তাদের বলেছি; কেউ যাতে অবৈধ পথে বিদেশ যেতে না পারে।

এএম