নিহতদের বাড়িতে স্বজনদের ভিড়

‘তিনটা লাশ একলা লইয়া যামু। আমারতো আর কিছু বাকি নাই। লাশ কয়টাই আমারে বহন করতে হইবে। এহন অ্যাম্বুলেন্সের অপেক্ষায় আছি। অনেক জায়গায় যোগাযোগ করছি। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স আইতেছে না। টাহা-পয়সা না হয় ধারদেনা কইররা বাড়ি যাইয়া ম্যানেজ করমু আনে। কিন্তু গাড়ি না পাইলে আমার সোনা মানিকেগো লইয়া যামু কেমনে?’

কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন মিরপুরের ঢাকা কমার্স কলেজ সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির সামনের সড়কে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নিহত তিনজনের স্বজন নাসির হাওলাদার। নাসির হাওলাদার নিহত মিজানের বাবা, মুক্তা বেগমের শ্বশুর ও লিমা আক্তারের দাদা। ছেলে, নাতি ও পুত্রবধূর মৃত্যুর খবর শুনে বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাতে টাকা ধার করে ঢাকায় রওয়ানা দেন তিনি। এখন টাকার অভাবে গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারছেন না তিনি।

শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে মুঠোফোনে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় নাসির হাওলাদারের।  

তিনি বলেন, ‘খবর হুইননা একজনের কাছ থেইকা আড়াই হাজার টাকা নিয়া ঢাকায় আইছি আমরা তিনজনে। এহন লাশ নিয়া বাড়ি যামু হেই টাহা হাতে নাই। মিজানের শ্বশুরে অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করছে, কত টাহায় জানি না। লাশ লইয়া বাড়ি পৌঁছার পর হয়তো কারো কাছ থেইকা কর্জ কইরা অ্যাম্বলেন্স ভাড়া দিমু, হেই নিয়ত করছি।  কেমনে কি হইলো কইতে পারি না। আমিতো আইয়া দেহি আমার সোনার মানিকেরা লাশ হইয়া পইড়া আছে। দুপুরে পোস্টমর্টেম শেষ করছে। এহন সব গুছাইয়া রওয়ানা দিতে রাইত ৯টা বাজবে। রাইতের মধ্যে বাড়ি পৌঁছাতে পারলে কাইল বেন বেলা (সকালে) গেরামের বাড়িতে দাফন দিমু।’

আরও পড়ুন : চোখের নিমেষে সব শেষ, অলৌকিকভাবে বেঁচে গেল সাত মাসের শিশুটি

নাসির হাওলাদার বলেন, ‘ছোট নাতি হোসাইনকে লগে লইয়া যামু। এহনো ওর ধারে যাইতে পারি নাই। যাওয়ার আগে একই অ্যাম্বুলেন্সে লইয়া যামু। দোয়া কইরেন, যেন মোর নাতিডা বাঁইচ্যা থাহে।’

মিরপুরের ঢাকা কমার্স কলেজ সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির সামনের রাস্তায় জমে থাকা পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারানো একই পরিবারের তিনজনের বাড়ি ঝালকাঠি সদর উপজেলার বাসন্ডা ইউনিয়নের আগরপাশা গ্রামে। তবে তারা সদর উপজেলার টিএন্ডটি রোড এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন।

আরও পড়ুন : এক রাতেই এলোমেলো সব, অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই হলেন লাশ

নাসির হাওলাদার বলেন, ‘আমার দুই পোলা, এক মাইয়্যা। পোলাগো মধ্যে মারা যাওয়া মিজান মেজো। চার বৎসর হইছে ও ঢাকা থাহে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাম-কাইজ কইরা সংসার চালায়। ও লেবুর শরবত, জুস বেচে সংসার চালাইতো।’

এদিকে ঝালকাঠি পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে নাসির হাওলাদারের বাড়িতে দেখা গেছে প্রতিবেশীদের ভিড়। মর্মান্তিক এই ঘটনার খবর পেয়ে দলে দলে সমবেদনা জানাতে আসছেন স্বজনরা। বাড়িতে নিহত মিজানের মা নিরু বেগম ও বোন রয়েছেন। তিনজনের মৃত্যুর খবরের পর থেকেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তারা। ক্ষণে ক্ষণে মূর্ছা যাচ্ছেন। কথা বলারও শক্তি নেই।

আরও পড়ুন : ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফেরা হলো না মিজান ও মুক্তার 

ঝালকাঠি পৌরসভার মেয়র লিয়াকত আলী তালুকদার বলেন, আমি এই বিষয়ে এখনো কিছু জানি না। আমি ঢাকায় আছি। তবে আপনি ১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের সাথে কথা বললে তিনি সব জানাবেন। দরিদ্র এই পরিবারকে সহায়তার কোনো সুযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি জেনে নিই আগে।

পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রেজাউল করিম জাকিরের মুঠোফোনে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার রাতে অতিবৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়ক তলিয়ে যায়। মিরপুরের ঢাকা কমার্স কলেজ সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির সামনের সড়কে জমে থাকা পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চারজনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে তিনজন একই পরিবারের। প্রাণে বেঁচে ফিরেছে নিহত মিজান-মুক্তা দম্পতির ৭ মাসের ছেলে হোসাইন। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/ আরএআর